ঋত্বিকের বাবার ছিল বদলির চাকরি। তাই ছোটবেলাটা নানান জায়গাতে কাটলেও, তাঁর জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল পদ্মা। এ নদী তাকে ছোটবেলা থেকেই বারবার টানত, তাড়িয়ে বেড়াত। এপার বাংলার ছবি করে কোন সময়েই মানসিক তৃপ্তি পাননি তিনি। তিনি বলতেন — “সেই নিসর্গ এখানে এখানে পাইব না। ও মুখের আদল ও কথা বলার ঢংটি এখানে পাইব না। দুনিয়ার কাছে ওই বলিয়া চালাইয়া দেওয়া যায়, এমন কিছু হয়তো সাজাইয়া গুছাইয়া দাঁড় করানো যায়। কিন্তু বায়োস্কোপ বড় সত্যবাদী। উহাতে চিঁড়ে ভিজিবে না। যাহার জন্যে করা সেই রূপকথাটি হারাইব।”
বাংলার নৈসর্গিক প্রকৃতি তাঁর কাছে রূপকথার চেয়ে কম ছিল না। বলা ভালো, বাস্তব জীবনের অপরূপ রূপকথা যার সন্ধানে ঋত্বিক কাটিয়ে দিলেন এ জীবন। ১৯৭১ এর পর সত্যজিৎ, ঋত্বিক প্রমুখদের স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে যাচ্ছিল সরকার। তখন বিমানটি পদ্মার ওপর আসতেই হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলান ঋত্বিক। এ কান্না এক সত্যিকারের বাঙালি সত্তা তাঁর স্মৃতি ফিরে পাবার কান্না। আর এই সমস্ত কারণের জন্যই সমসাময়িক কালে তিনি ছিলেন এক অস্বস্তিকর ব্যক্তিত্ব। ঋত্বিক প্রসঙ্গত অপ্রসঙ্গত বারবারই গুঁজে দিয়েছেন তাঁর রূপকথা, বাংলার নদী ও মানুষের কথা। একে যদি জিগির বলা হয় তবে জিগিরই — বাংলার জিগির। একজন সন্ন্যাসী যেমন জীবনের বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় কোলাহলের ভিতর একটা নির্জন স্বাধীন স্বেচ্ছানির্বাসিত ভূমি খুঁজে নেন ঋত্বিকও খুঁজেছেন শেষ নিশ্বাস অবধি। — “সেই সরল রূপকথা, যাহা দেখিলে যুক্তি চুপ, বড় বড় থিওরি মাথা চুলকাইয়তে আরম্ভ করে ছোট ছোট ডানপিটের দল রুদ্ধশ্বাস গল্পের জন্য চাগাড় দিয়া উঠিয়া বসে, — তাহা কোথায়? আমার চৌহদ্দির মধ্যে নাই।”
ঋত্বিকের ভাবনায় পদ্মার একটা ছবি তুলে ধরা যাক — “আমার দিন কাটি যাচ্ছে পদ্মার ধারে। একটি দুঁদে ছেলের দিন। গহনার নৌকায় মানুষ দেখিয়াছি। যেন অন্য গ্রহের বাসিন্দা। মহাজনি হাজার- দু’হাজার মনি ভাড়া করিয়া পাটনা-বাঁকিপুর-মুঙ্গের অঞ্চলের মাল্লারা পার হইয়া যাইত। এক জাতীয় ভাঙা দেহাতি আর পদ্মপারী বাংলার টান মাখানো কথা বলিয়া। জেলেদের দেখিয়াছি, ইলসাগুড়ির প্রথম বর্ষায় বেজায় খুশি হইয়া বেসুরো টান মারিত। জল মাখানো হাওয়াতে দমকায় দমকায় ভাসিয়া আসিত মন কেমন করা পাগল সুর। স্টিমারে শুইয়া রাত্রে দোল খাইয়াছি মাতাল নদীর দাপটে, আর শুনিয়াছি ইঞ্জিনের ঠমঠম, সারেঙ্গের ঘন্টি। খালাশির বাঁও না মেলে আর্তনাদ।”
“পদ্মার শরতে নৌকা লইয়া পালাইতে গিয়া একবার ঢুকিয়া আর বাহির হইতে পারি না — তিন মাথা সমান উঁচু কাশবন হইয়াছে কাতলামারীর চরটার কাছে। ভীষণ সাপ থাকে ওখানে। নৌকা দুলাইয়া দুলাইয়া চেষ্টা করিতে যাইয়া সেই ডাকাতিয়া কাশের ঝোপে সাদা রেণু উড়াইয়া দেহমন আচ্ছন্ন করিয়া নিশ্বাস প্রায় আটকাইয়া দিয়াছিল। কাশগুলি পাকা ছিল। একবার সিন্ধু গৌরবের রাজা জাহিরের পার্টির জন্যে হায়ার হইয়া গিয়া ট্রেন ফেল করিয়া সন্ধ্যেবেলা পৌঁচিয়াছি অপরিচিত রেল স্টেশনের লাইনের লাল আলোর রহস্যময় পাড়াগাঁয়ে। সামনের হাওরবিল ডাকসাইটে ভূতের জায়গা, কোজাগরির আগের রাত্রে সেই আবছা বিল মাঝে মাঝে জাগিয়া আছে দ্বীপের মতো গ্রাম। নীহার পড়িতেছে। কাঁপিতেছে। শেষে বোঝা গেল, আমাদের ধন্দ লাগিয়াছে। দু-ঘন্টার পথ সারা রাত্রে পার হইতে পারিতেছি না। পাক খাইতেছি। সেই শেষ রাত্রে দাঁতে দাঁত লাগা হিম সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।”
Discussion about this post