১৯৬৪ সালের ব্রাজিল। অর্থনৈতিক সমস্যা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে ব্রাজিলের ক্ষমতা চলে গিয়েছিল সামরিক রাষ্ট্রনেতার হাতে। তারপরই শুরু হয়েছিল বিশৃঙ্খলা, অনৈতিক অত্যাচার। দেশজুড়ে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল প্রতিবাদী লেখকদের লেখা বইগুলিকে। ব্রাজিলের রাজপথে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সেই সব ‘মুক্তমনা’ গ্রন্থ। ঠিক এই সময়, সেইসব বই জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া বাবাকে দেখেছিল এক কিশোর। পড়ার খিদে, জানার খিদে তার বেড়ে গিয়েছিল। জেদ তৈরি হয়েছিল গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার। এই কিশোরই পরবর্তীকালে ‘ইয়েস টু লাভ, নো টু টেরর’ স্লোগান দিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে, তা কী সে নিজেও জানতো?
ছোটবেলার অভিজ্ঞতা, পড়াশোনার কারণেই সম্ভবত এই কিশোর ছিল একেবারে অন্যরকম। ভবঘুরের মত মুখে একরাশ দাড়ি, হেয়ারব্যান্ড, অথচ চোখদুটি যেন অদ্ভুত মায়াবী ও শীতল। এই কিশোরের নাম সক্রেটিস। ১৯৫৪ সালের ১৯ই ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলের বেলেম শহরে জন্মে বেড়ে উঠছিলেন সক্রেটিস। ছেলেবেলায় পাড়ায় ফুটবল খেলে নামডাক পেয়েছিলেন, আবার একইসঙ্গে পড়াশোনাতেও ছিলেন পটু। কুড়ি বছর বয়সে তিনি নাম লেখান বোটাফোগা ক্লাবে। ফুটবলের পাশাপাশি তিনি চালিয়ে গেলেন পড়াশোনা। একাধারে তিনি হলেন একজন প্রফেশনাল ফুটবলার এবং একজন মেডিসিন ও সাইকিয়াট্রিক ডক্টরেট ডিগ্রিধারী।
১৯৭৯ সালে ব্রাজিল জাতীয় দলে সক্রেটিসর অভিষেক হয়। অসাধারণ নেতৃত্বগুণের কারণে মাত্র দেড় বছরের মাথায় অধিনায়কের দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৮২ সালে তারকায় ভরা ব্রাজিলের দলে ছিলেন তিনিও। ১৯৭৯ সালেই সক্রেটিস যোগদান করেন করিন্থিয়ান্সে। ঐতিহাসিকভাবে করিন্থিয়ান্স শ্রমিকদের ক্লাব। ক্লাবের প্রধান মন্টেইরো ছিলেন সোশ্যালিস্ট, গণতন্ত্রকামী মানুষ। সক্রেটিস রব তুললেন ক্লাবেই যেন গণতন্ত্র চালু করা হয়। পুরো ব্রাজিলে তখন রাজনৈতিক কোনো নির্বাচন হয় না। করিন্থিয়ান্স চালু করলো ভোটভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেবার সংস্কৃতি। ক্লাবের বোর্ড মেম্বার থেকে খেলোয়ার, কর্মচারী সকলেই সমান গুরুত্ব পেতেন। এর নাম হয়ে গেল ‘করিন্থিয়ান্স ডেমোক্রেসি’। একটি ফুটবল ক্লাব বুক চিতিয়ে দাঁড়ালো একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সক্রেটিস ছিলেন তার পথপ্রদর্শক।
চিরাচরিত ব্রাজিলিয়ান সাম্বা ফুটবলের ভক্ত। পজিশন ছিল এটাকিং মিডফিল্ডার। গোল করায় দক্ষ। পুরো দলের খেলা একাই চালনা করতেন মাঝমাঠ থেকে। স্প্যানিশ মিডিয়া তাঁকে বলত ‘‘Not Athlete, Just Artist’’। ১৯৮২ সালে এক কাপ ফাইনালে তাঁর পরিকল্পনাতে দল ‘ডেমোক্রেসিয়া’ প্রিন্ট করা জার্সি গায়ে খেলতে নামে। পরিণামবশত সারা ব্রাজিলে আলোড়ন বয়ে যায়। স্টাইলিশ দাড়ি আর লম্বা চুলের ‘কুল সেনসেশন’ সক্রেটিস হয়ে ওঠেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একজন প্রতীক স্বরূপ। ফুটবল বিশ্বে তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন মিডফিল্ডার। ব্রাজিলের গণতন্ত্রকামীদের কাছেও তিনি আইকন। জীবিতাবস্থায় সমাজের কাছে ছিলেন বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক। তিনি ছিলেন এমন একজন ফুটবলার, যাঁর আদর্শ কোনো ফুটবলার নন, বরং তাঁর আদর্শ ছিলেন জন লেনন, ফিদেল ক্যাস্ট্রো আর চে গুয়েভারা।
Discussion about this post