‘বামনগাজী’, নামটির সঙ্গেই মিশে রয়েছে দুটি ভিন্ন ধর্মের অদ্ভুত সহাবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় খাড়িগ্রামে, বামনগাজীর মন্দিরে গেলে দেখা মিলবে এই মিলনের। সেই মন্দিরে সনাতন হিন্দু এবং ইসলাম উভয় ধর্মের মানুষ আসেন। পুজো দেন, মানত করেন। দূরদূরান্তের মানুষরাও আসেন, কারণ বিশ্বাস রয়েছে এই দেবতা অত্যন্ত জাগ্রত।
লোককাহিনীতে গাজী সাহেব একজন অলৌকিক ক্ষমতাশালী ধর্ম প্রচারক হিসেবে পরিচিত। কথিত আছে, দক্ষিণ ২৪ পরগণার ওই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে দেবতা দক্ষিণরায়ের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ বাঁধে। স্বয়ং ঈশ্বর নাকি কৃষ্ণ ও পয়গম্বরের মিলিত বেশে আবির্ভূত হয়ে দুজনকে শান্ত করেন। অন্যদিকে, লৌকিক কাব্যগাথা ‘গাজীমঙ্গল কাব্যে’ পরাজিত হয়েছেন বাবা দক্ষিণরায়। আবার, আব্দুল গফুরের ‘কালু গাজী ও চম্পাবতী’ কাব্যে সমস্ত হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে গাজী সাহেবের বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। মন্দিরের বিগ্রহটিও সম্ভবত হিন্দু দেবতা ও গাজী সাহেবের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবেই তৈরি। ঘোড়ার ওপর সুঠাম দেহী, গায়ে পৈতে নিয়ে আসীন দাঁড়ি গোঁফওয়ালা বামনগাজী সাহেব। নদী-জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলে বাঘ, সাপদের নাকি ইচ্ছামত বশ করতে পারতেন গাজী সাহেব। কুমীর দেবতাও ছিল তাঁর বন্ধু।
“সর্বচিন্তা পরিহরি, বামনগাজীরে স্মরি/নিয়মিত জলপড়া করহ সেবন/ অচিরে জানিবে তবে কোনও রোগ নাহি রবে/তাজপুরে গিয়া পুনঃ দাও হে পূজন।’’ এমনই ছড়া বামনগাজীকে নিয়ে স্থানীয় মানুষের মুখে চালু আছে। মানুষ বিশ্বাস করেন বামনগাজী রোগব্যাধি নিরাময়ের দেবতা। মানত করলেই নাকি সেরে যায় রোগ। ষাট পেরনো অঞ্জনাদেবী জানালেন, “ছোটবেলায় একবার ফোঁড়া হওয়ায় আমাকে বামনগাজীর মন্ত্রপড়া তেল দেওয়া হয়েছিল। হাতেনাতে ফল পেয়েছিলাম। শুনেছিলাম, কেউ নাকি মানত করে, তা পূরণ করেনি বলে বামনগাজী তাকে শাস্তিও দিয়েছিলেন।’’ ভক্তদের বিশ্বাস, মন্দিরের ধুলো গায়ে মাখলেও রোগ সারে।
প্রতি বছর অক্ষয় তৃতীয়াতে হয় বামনগাজীর বিশাল মেলা। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু হয় উৎসব। হয় গাজনের প্রতিযোগিতা এবং যাত্রাপালা। মেলা চলে তিনদিন। গ্রাম বাংলার লোকউৎসবের সমস্ত উপকরণ এই মেলায় উপস্থিত থাকে। এভাবেই বছরের পর বছর লৌকিক দেবতা ‘বামনগাজী’র মধ্য দিয়ে জীবিত রয়েছে ধর্মীয় সম্প্রীতি।
Discussion about this post