আজ ২৫ শে মে। নকশালবাড়ি দিবস। ১৯৬৭ সালে আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি গ্রামের প্রসাদুজোতে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ধনেশ্বরী দেবী, সীমাশ্বরী মল্লিক, নয়নেশ্বরী মল্লিক, মুরুবালা বর্মন, সোনামতি সিং, ফুলমতি দেবী, সামসরি শৈবানি, গাউদ্রাউ শৈবানি এবং কৃষক খর সিং মল্লিকের সঙ্গে আরও দুই শিশুর। ১৯৪৭-৪৮ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীকাকুলামে কৃষকদের অধিকারের দাবিতে ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষক ভেমপাটাপু সত্যনারায়ণ ও আদিভাটলা কাইবাসাম। আন্দোলনকারীদের কন্ঠ উজ্জীবিত করতে গান লিখেছিলেন সুব্বারাও পানিগ্রাহী।
সেই আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতেও শুরু হল আন্দোলন। শিলিগুড়ি থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গল ও পাহাড় ঘেরা এই ছোট্ট জনপদটিতে তখন সামান্য কয়েক ঘর কৃষকের বাস। তারা নিজেদের স্বাধীন কৃষকে পরিণত করার দাবি নিয়ে শুরু করে আন্দোলন। শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গই নয়, নকশাল আন্দোলনের আঁচ গিয়ে পড়ল দক্ষিণবঙ্গেও। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সেই সময়ের তরুণ সমাজের একাংশের মধ্যে। আন্দোলনের রাশ ধরলেন চারু মজুমদার, কানু স্যান্যাল, খোকন মজুমদারদের মতো নেতারা। ৭০-দশকের শুরু থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করলেন এই ‘অ্যানার্কিস্ট রিভোলিউশনারিরা’।
“সত্তর দশকের কলিকাল কলকাতায় অসুররাই বধ করছে দেবতাদের, মুক্তিযুদ্ধের ট্যাঙ্কের চাকা পড়ে থাকছে কালোয়ানের দোকানে; কলেজ স্ট্রিটে একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে কবিতা ও বোম পড়ার শব্দ। ম্যাগাজিন শব্দটি জড়িয়ে যাচ্ছে রাইফেল ও কবিতার সঙ্গে, আটচল্লিশ ঘন্টার সর্বাত্মক হরতালে খোলা থাকছে কেবল ফুলের দোকান, যেহেতু, শ্মশানে হরতাল নেই কোনো–মৃত্যুর ধর্মঘট নেই।”
ফলে নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ, শুধু কৃষক বিদ্রোহেই সীমাবদ্ধ থাকল না। কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র, শহরের প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়ল ‘প্রশ্ন’। প্রশ্ন থেকে জন্ম নিল বিপ্লবী সাহিত্য। মাও সে তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আদর্শে উঠে এসেছিল অসংখ্য সাহিত্য, সাহিত্য পত্রিকা। আপাতদৃষ্টিতে নকশালবাড়ি আন্দোলন ব্যর্থ হলেও, সাহিত্য-শিল্প চিন্তায় এই পরিবর্তন দেখিয়ে গিয়েছিল এক অন্যতর দিশা। উনিশ শতকের শুরুতে ডিরোজিয়ানরা সমাজের সংস্কারগুলির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছিল। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সেই প্রশ্নই যেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়েছিল মানুষের চিন্তা চেতনায়। তাই বিনয় ঘোষ তাঁর ‘মেট্রোপলিটান মন মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ’ গ্রন্থে নকশালদের ডিরোজিয়ানদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সত্তরের এই পালটে দেওয়ার স্বপ্নকে আটকে রাখা হলেও, বর্তমান শিল্প-সাহিত্য-ইতিহাস চেতনার মধ্যে দিয়ে আজও সেই স্বপ্ন বহমান। আজ সেই স্বপ্নের সূচনার ৫৬ বছর পূর্তি!
Discussion about this post