দুর্গা পুজো, কালি পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো সব কাটিয়ে বাঙালি এবার মেতেছে রাস উৎসবে। রাসের কথা বলতে গেলেই প্রথমে আসে নবদ্বীপের রাসের কথা। তারই দোসর শান্তিপুরের রাস। এক সময় বৈষ্ণবদের হাত ধরে শুরু হলেও, এখন তা সর্বজনীন। শান্তিপুরের রাসে পুরাণ আর ইতিহাস মিলে মিশে এক হয়ে যায়।
পুরাণ বলছে, শান্তিপুরে রাসের সূচনা করেন অদ্বৈতাচার্য। শোনা যায়, তিনি ছিলেন শিবের অবতার। রাস সম্পর্কে অবগত না হওয়াতে সে নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিলো শিবের মনে। মানুষের বিশ্বাস যোগমায়া দেবীও নাকি কৃষ্ণের প্রতি মোহিত হয়ে রাসে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৬০০ গোপিনী নিয়ে মত্ত অবস্থায় রাস প্রাঙ্গণে শিবের উপস্থিতি টের পেয়ে যান কৃষ্ণ। তখনই তিনি রাস প্রাঙ্গন ত্যাগ করেন। কারণ, রাসে কৃষ্ণ ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশ ছিলো নিয়মের বাইরে। এই সময়ে সখীরা ভাবতে থাকেন, এবার তাহলে রাস হবে কী করে? তখনই তারা ঠিক করেন, শ্রীরাধাকে দোলায় চাপিয়ে নগর পরিভ্রমণ করা হবে। সেদিনের জন্য রাই-ই রাজা। এ কারণে শিবের আর রাস দেখা হয় না। তখন তিনি ঠিক করেন এই রাস তিনি একদিন মর্ত্যবাসীর সামনে আনবেন। যেহেতু তিনি দ্বাপরে রাস ভেঙেছিলেন তাই অদ্বৈতাচার্য রূপে আবির্ভূত হন।
অন্যদিকে ইতিহাস বলছে, বারো ভুঁইঞার এক ভুঁইঞা ছিলেন প্রতাপাদিত্য। তিনি পুরীর রাজা ঈন্দ্রদ্যুম্নের আমলে পুজিত দোলগোবিন্দের বিগ্রহ যশোরে নিয়ে আসেন। কিন্তু মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে প্রতাপাদিত্য সেই বিগ্রহ তুলে দেন বারো ভুঁইঞাদের গুরু অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। তিনি সেই বিগ্রহকে শান্তিপুরে নিয়ে এসে রাধা রমণ জিউ নামে প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু মথুরেশ গোস্বামীর মৃত্যুর পর এক দিন চুরি হয়ে যায় সেই রাধা রমণ জিউ এর বিগ্রহ। স্থানীয় এক ব্যক্তি স্বপ্নাদেশের পর, ওই মূর্তি উদ্ধার হয় এক বিল থেকে। এই ঘটনায় গোস্বামীদের মনে হয়, মাধব বুঝি রাধা বিনা কষ্ট পাচ্ছেন। তাই প্রতিষ্ঠা করা হয় রাধা দেবীকে। এর পর রাসের দিন তারা মিলিত হয়। গোস্বামীদের শিষ্য খাঁ চৌধুরীদের প্রস্তাবে রাসের এই দৃশ্য শোভাযাত্রা হিসেবে দেখানো হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। এটাই ভাঙা রাস নামে প্রচলিত।
রাস যেমন রাধা কৃষ্ণের মিলন প্রাঙ্গণ, তেমনি সব ধর্ম সব বর্ণের মানুষের মিলন ক্ষেত্র। বর্তমানে রাসের শোভাযাত্রায় যাদের রাই রাজা সাজানো হয়, তাদের বয়স হতে হয় ১২ বছরের নিচে। রাইরাজা হওয়ার অন্যতম শর্ত তাদের ব্রাহ্মণ পরিবারের হতে হবে। আগের রাতে নিরামিষ আহারের পর শিশু কন্যাদের সাজিয়ে বিগ্রহের সামনে বসিয়ে শুরু হয় রাসলীলা। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ রাই রাজাদের আকর্ষণে আজও ছুটে আসেন শান্তিপুরের রাস উৎসবে।
চিত্র ঋণ – শান্তিপুর রাস উৎসব – Santipur Raas Festival
Discussion about this post