বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে আমরা কে নাহ চিনি! তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নাকের ডগাতেই বিভিন্ন দুঃসাহসিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাঁর নাম। ছদ্মবেশ নিতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার! তাই ব্রিটিশ পুলিশ-বাহিনী তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারত না। তবে কখনও বিপদের আঁচ পেলেই তিনি দেশের বাইরে আত্মগোপন করতেন। এভাবেই একসময় তিনি জাপান চলে আসেন। যদিও তাঁর বৈপ্লবিক সত্ত্বার বাইরেও জাপানে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের বাইরে সম্পূর্ণই ভিন্ন একটি কারণে জাপানের মানুষ চিনেছিল তাঁকে। একজন দক্ষ রাঁধুনি হিসাবে। এমনকি জাপানের বিখ্যাত ‘নাকামুরা’ বেকারির নাম বদলে হয়ে গেছিল ‘নাকামুরায়ার বোস’! আজ সেই কাহিনীতেই আসা যাক।
১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লির চাঁদনি চকে বোমার আঘাতে আহত হলেন তৎকালীন ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ। এই হামলার মূল চক্রান্তকারী হিসাবে সবার সামনে উঠে এল বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম। কিন্তু ধরা হবে কি! তাঁকে তো খুঁজেই পাওয়া গেল না। পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে ধরা পড়ার আশঙ্কায় দেশ ছেড়ে পালালেন তিনি। জাপানের প্রখ্যাত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্যান এশিয়ান আন্দোলনের নেতা মিৎসু তোয়ামার সাহায্যে জাপানের টোকিওতে এসে উঠলেন রাসবিহারী বসু। লুকিয়ে আশ্রয় নিলেন রাজনীতিবিদ তোওয়ামা মিৎসুরুর কাছে। কিন্তু জাপানি পুলিশ-বাহিনী তাঁর খোঁজ পেয়ে যায়। ফলে বাধ্য হয়ে তোওয়ামার বুদ্ধিতেই তিনি গিয়ে আশ্রয় নেন শিনজুকুতে জাপানের বিখ্যাত বেকারি-ব্যবসায়ী আইজো সোমার বাড়িতে। তাঁর ‘নাকামুরায়া’ বেকারি ছিল জাপানের অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত এক বেকারির দোকান।
সেখানে থাকাকালীনই সোমার বড় মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের পর রাসবিহারী তাঁর শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রস্তাব দেন তাঁদের বেকারিতে পাউঁরুটি-বিস্কুটের পাশাপাশি তিনি মাংসের ঝোলও বিক্রি করতে চান। মূলতঃ তাঁদের উদ্যোগেই বেকারির ছাদে খোলা হল একটি রেস্তোরা, নাম- ‘নাকামুরায়া ক্যাফে’। ভারতীয় বিপ্লবীর তত্ত্বাবধানে সেখানে রান্না হতে থাকল মাংসের কারি। যা খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেল প্রায় সকলেই। জাপানের মানুষের সঙ্গে তিনি এই কারির মাধ্যমেই পরিচয় করালেন এদেশের রন্ধন-শৈলীর। অচিরেই সেদেশে এই ভারতীয় কারি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করল।
আজও রাসবিহারীর দেওয়া রেসিপি মেনেই মাংসের কারি বানানো হয় সেখানে। রেস্তোরাঁর প্রবেশ পথে আজও শোভা পায় ধুতি ও কালো কোট পরিহিত বাঙালি বিপ্লবীটির সস্ত্রীক প্রতিকৃতি। আশেপাশের অন্যান্য রেস্তোরা থেকে প্রায় দ্বিগুণ দাম হওয়া সত্ত্বেও লাঞ্চ টাইমে এখানে খালি থাকে না একটিও টেবিল। রাসবিহারী বসুর দেওয়া সেই একই রেসিপি মেনে তৈরী হওয়া সেই কারি বর্তমানে বিপণন হয় গোটা জাপান জুড়ে। রাসবিহারী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ আমাদের স্মৃতিতে আজ ধূসর। কিন্ত নাকামুরায়ার ভারতীয় কারির মধ্য দিয়ে কয়েক লাখ জাপানবাসীর মানসপটে আজও অমলিন তার উপস্থিতি।। তাই বলা যেতেই পারে, বাঙালি বিপ্লবীটির তৈরি সেই মাংসের কারির স্বাদ জাপানের মানুষের আজও জিভে লেগে আছে।
Discussion about this post