তখন ভারতে চলছে বিপ্লবের অগ্নিযুগ। গোটা দেশের মানুষ বিভোর স্বাধীনতার স্বপ্নে। এদিকে লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ এক বিপ্লবী। প্রাণে বাঁচতে ১৯১৫ সালে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। পি এন টেগোর ছদ্মনাম নিয়ে ৮ জুন পৌঁছলেন টোকিওতে। সেখান থেকে আশ্রয় নিলেন জাপানেরই আরেক জনপদ শিনজুকুতে। সেখানকার এক দোকান-বাড়ি ‘নাকামুরায়া’র পিছনে ছিল নির্জন এক ভুতুড়ে ভবন। সেখানেই আপাততঃ আশ্রয় নিলেন ব্রিটিশ-বিরোধী ভারতীয় বিপ্লবের প্রাণপুরুষ রাসবিহারী বসু। সঙ্গী ছিলেন আরেক বিপ্লবী বন্ধু হেরম্বলাল গুপ্ত।
চলতে লাগল দুই বঙ্গ তনয়ের গোপন কর্মকাণ্ড। শিনজুকুর ওই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আইজো সোমা ও তাঁর স্ত্রী কোক্কো দুজনেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। কোক্কো ইংরেজি বুঝতে ও বলতে পারতেন। অচিরেই তিনি এই দুই বঙ্গ তনয়ের অভিভাবিকা হয়ে উঠলেন। তথ্য আদান প্রদানের দূত আর অনুবাদক হিসাবে মাঠে নামলেন পরিবারের ওই জাপানী দম্পতির বড় মেয়ে স্কুল-ছাত্রী তোশিকো। এভাবেই চলছিল বেশ। কিন্তু তিন মাস পর হঠাৎ দেখা দিল মতানৈক্য। হেরম্বলাল জাপান ছেড়ে চলে গেলেন মার্কিন মুলুকে। কোক্কো পরিবারের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন বছর ত্রিশের রাসবিহারী। এদিকে ব্রিটিশরাও তাদের তল্লাশীর বজ্রমুষ্টি আরও কঠিন হল। যার জেরে রাসবিহারীর আত্মগোপন হল আরও কঠোর। ঠিকানা বদল করতে হল তাঁকে। এই অবস্থায় সোমা দম্পতি ঠিক করলেন সদ্য স্কুল ডিঙোনো তোসিকোর সঙ্গে রাসবিহারীর বিয়ে দেবেন। ১৯১৮-র ৯ জুলাই সংসার বাঁধলেন তাঁরা।
এদিকে বিয়ের চার মাস পরেই স্বাক্ষরিত হল ভার্সাই চুক্তি। ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে মিত্র শক্তির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য জাপানের ওপর চাপ বাড়তে লাগলো। কোক্কো সোমা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, অন্তত ১৭ বার বাড়ি বদল করতে হয়েছে নবদম্পতিকে। বহু বার ওঁদের নিতে হয়েছে ছদ্মনাম। এদিকে মেয়ে-জামাইয়ের চিন্তায় জেরবার কোক্কো। এভাবেই কাটল কিছু বছর। একদিন কোক্কো চলেই এলেন রাসবিহারী-তোশিকো’র সংসার দেখতে। গিয়ে যা দেখলেন, তাতে তিনি চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। আলো-হাওয়া বিহীন একটা অন্ধকার ঘর। সেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে একরাশ অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, দুশ্চিন্তার মধ্যেই চলছে বেঁচে থাকার লড়াই। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে তোশিকো। আর তাঁর স্বামী ডুবে গিয়েছেন ভারতকে স্বাধীন করার দুরূহ কর্মযজ্ঞে।
এসবের মধ্যেই ঘটে গেল অঘটন। ঠাণ্ডা-জ্বরে ক্রমাগত ভুগছিলেন তোশিকো। সেই সময় যক্ষার আধুনিক চিকিৎসা ছিল না। ১৯২৫ সালের মার্চ মাসে সব শেষ। চিরতরে বিদায় নিলেন তোশিকো। মাতৃহারা ছেলে মাসাহিদে আর মেয়ে তেৎসুকো বড় হতে লাগল দিদা কোক্কোর কাছে। অন্যদিকে প্রচণ্ড মানসিক আঘাত আর নিঃসঙ্গতা কাটাতে রাসবিহারী আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন দেশকে স্বাধীন করার যজ্ঞে। সেই পরিস্থিতিতে রাসবিহারীকে কিছু যুবতী বিয়ে করার আগ্রহ দেখান। এমনকি শ্বাশুড়ি কোক্কো নিজেও জামাইকে ফের বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আদর্শবাদী এই দামাল ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ভুলতে পারেন নি তার স্ত্রীকে। সত্যিই তো! যথেষ্ট অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ছিলেন তোশিকো। খুব সহজেই রাসবিহারীর চেয়েও ঢের ভালো পাত্রের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। সংগ্রামের পথ যেন সত্যি বেঁধে দিয়েছিল দু’জনের বন্ধনহীন গ্রন্থি। আর তাই হয়তো সংসার বাঁধার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামলেন না বাংলার এই উপেক্ষিত মহান বিপ্লবী।
Discussion about this post