সংসার সামলানোর পাশাপাশি, শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পকর্মের সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন এক নারী। তিনি রাধারানিদেবী। তাঁকে নিয়ে নানা শৈল্পিক কাজ করেছিলেন রামকিঙ্কর। তাঁকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক ছবি এঁকেছেন তিনি এমনকি ভাস্কর্যের কাজও করেছেন। তাঁদের সম্পর্কের কোন সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না, অর্থাৎ তাঁদের বিয়ে হয়নি। ফলে সেই সময় স্বাভাবিকভাবেই দুইজনের সম্পর্ক নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। রাধারানিদেবীর বাবা তাঁর শান্তিনিকেতন আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রামকিঙ্কর ছিলেন অনড়। এই রাধারানি দেবীর আত্মত্যাগ রামকিঙ্করকে অনেকখানি উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল নিঃসন্দেহে।
রাধারানিদেবীর জন্ম বর্ধমানের আউশগ্রামের গুসকরার কাছে কোনও এক গ্রামে। সেখান থেকেই বাবার পছন্দ করে দেওয়া বোলপুরের এক মুদি দোকানের মালিকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। তখন তিনি মাত্র নয় বছরের বালিকা। কিন্তু তাঁর বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। বিয়ের পরেই সাংসারিক অশান্তি শুরু হয়। সেই অশান্তির মাঝে নিজের বাড়িতে ফিরে যাবেন, সেই অবস্থাও ছিল না রাধারানিদেবীর। আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে বোলপুরে কাজের খোঁজে এলেন তিনি। কাজ পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠা কন্যা মীরাদেবীর বাড়িতে। সেখানেই রাধারানিদেবী প্রথম রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন।
এই কাজ করতে করতেই শান্তিনিকেতনে তাঁর আলাপ হয়েছিল শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের সঙ্গে। ধুতির ওপর ফতুয়া পরা অগোছালো চেহারা, কালো, ঝাঁকড়া চুল উজ্জ্বল চোখের মানুষটি। মীরাদেবীর কাছে এসে রাধারানিকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন রামকিঙ্কর। কারণ, বাড়িতে রান্না, দেখাশোনার লোক নেই। অবশেষে রাজি হন মীরাদেবী। শেষ পর্যন্ত রামকিঙ্করের জীবনের বড় ভরসা হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন রাধারানিদেবী।
এক বছর খবর এল ‘দেশিকোত্তম’ পেয়েছেন রামকিঙ্কর। ছাত্ররা জানাল, তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। উপাচার্যও উপস্থিত থাকবেন সেই অনুষ্ঠানে। রামকিঙ্কর জানালেন, মঞ্চে উপাচার্য এবং তাঁর পাশে সমমর্যাদায় রাধারানিকে আসন দিলে তবেই তিনি সংবর্ধনা সভায় যাবেন। চিকিৎসার জন্য রামকিঙ্করকে যখন কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল, সে সময়েও রামকিঙ্কর শিশুর মতো কাকুতি মিনতি করেছিলেন রাধারানিদেবীর কাছে। তাঁদের ভুবনডাঙার বাড়িটি নিয়ে বলে গিয়েছিলেন, “আমাদের বাড়ি কখনও ছেড়ে যাবে না।’’ সেই কথা রেখেছিলেন রাধারানি দেবী। ১৯৭৮, ১৮ নভেম্বর ভুবনডাঙার ওই বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
Discussion about this post