চারদিক ঘেরা ঘন জঙ্গল। অরণ্যের ধারে জনবসতি। আর সেই সঙ্গে বছরভর হাতির উপদ্রব — এমনই ভয় আর ভক্তির মিলনে গড়ে উঠেছে বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের রামকানালি গ্রামের গজলক্ষ্মী পুজো। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করেন, এই দেবীর কৃপাতেই তাঁদের জীবন, ঘরবাড়ি ও ফসল রক্ষা পায় বনের দানবীয় হাতির দল থেকে।

প্রায় দেড়শো বছর আগে শুরু হয়েছিল এই পুজো। সে সময় রামকানালি গ্রাম ছিল আরও ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। হাতির দল প্রায়ই হানা দিত ক্ষেতের পর ক্ষেত, ভেঙে দিত ঘরবাড়ি। চাষবাস করা ছিল দুরূহ কাজ। সেই দুর্দিনে এক অলৌকিক বিশ্বাস জন্ম নেয় গ্রামের মানুষের মনে — দেবী লক্ষ্মীর ‘গজলক্ষ্মী’ রূপই তাঁদের রক্ষা করতে পারেন। সেই বিশ্বাসকে আশ্রয় করেই গ্রামের মানুষ মাটির ঘরে শুরু করেন গজলক্ষ্মীর আরাধনা। পরে সময়ের সঙ্গে সেই মাটির মন্দিরই রূপ নেয় পাকা গৃহে, আর পুজো পরিণত হয় এক মহোৎসবে।
সারা রাজ্য যখন কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে ধনদেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় মগ্ন, রামকানালিতে তখন পূজিত হন হাতির পিঠে আরোহিনী গজলক্ষ্মী। মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত হয় শোভন প্রতিমা— দেবী লক্ষ্মী, কিন্তু তাঁর বাহন হাতি। আগে হ্যাজাক আলোয় আলোকিত হত এই পূজা; এখন বৈদ্যুতিক ঝলমলে আলোয় মণ্ডপসজ্জা হয়, চলে তিন দিনব্যাপী আয়োজন। গাঁয়ের তরুণেরা মিলে আয়োজন করেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা বসে মন্দিরের প্রাঙ্গণে।
রামকানালিতে দুর্গাপুজো হয় না, তাই গ্রামের মানুষের উৎসববোধ এই গজলক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করেই। আশপাশের গ্রাম থেকেও ভিড় জমে এই সময়ে। জঙ্গলের ভয়াবহ বাস্তবতার মাঝেও রামকানালি আজও বাঁচিয়ে রেখেছে বিশ্বাসের আলো। দেড়শো বছরের পুরনো এই গজলক্ষ্মী পুজো শুধু ভক্তির প্রতীক নয়, তা হয়ে উঠেছে রামকানালি গ্রামের এক অনন্য ঐতিহ্য — যেখানে ভয়ের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে অটুট আস্থা আর দেবীর করুণাময় আশ্রয়।
Discussion about this post