সুপ্রভাত। যদিও জানি আজ বাঙালির সকাল অনেক আগেই হয়েছে। ব্যস্ত রোজনামচায় প্রায় অবাঞ্ছিত ধুলো পড়া রেডিওটার যে আজ ‘আলোর বেণু’ বাজিয়ে ওঠার দিন। প্রথম থেকেই এই বছরটা আপাদমস্তক বিষণ্ণতায় মোড়া। মহালয়া এসে গেলেও তিলোত্তমার মুখ এখনো ঢেকে যায়নি বিজ্ঞাপনে, গড়িয়াহাট হাতিবাজারেও কেনাকাটার উপচে পড়া ভিড়ের চিত্র নেই। একে তো করোনা তার উপর মহালয়ার প্রায় এক মাস পর এবার দুর্গাপুজো, তাই স্বভাবতই মানুষের উত্তেজনা কম।
তবুও রেডিওতে সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ কণ্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়া আজও মহালয়ার ভোরে ঘুম ভাঙে না বাঙালির। সারাবছর অবজ্ঞা-অবহেলা সইলেও মহালয়ার ভোরে রেডিওকে উপেক্ষা করার মত স্পর্ধা বা সাহস কোনোটাই এখনো বাঙালির হয়নি। বাণিজ্যিকভাবে রেডিওর পথচলা শুরু বিশ শতকের গোড়ার দিকে। ভারতে তার আগমন ঘটে আরও বেশ কিছুটা সময় পরে। এক সময় মানুষের বিনোদনের মূল উপাদান ছিল এই রেডিও।
তারপর প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে স্মার্টফোনের ওভার-স্মার্ট ফিচারের উপর নির্ভরতা বাড়তেই ঘড়ি, ল্যান্ড ফোন, টিভির মতোই রেডিওর দরকারও ফুরিয়েছে। আর ক্রমেই এই যন্ত্র হয়ে উঠেছে মহালয়ার দিনের প্রধান নস্টালজিয়া। কিন্তু আর সবাই রেডিওকে ভুলতে বসলেও, কুমোরটুলির ‘রেডিও ম্যানের’ সংগ্রহে জায়গা করে নিয়েছে হরেক রকমের রেডিও। কুমোরটুলির একটি ছোট্ট দোকানঘরে কাজ করেন কলকাতার রেডিওম্যান অমিত রঞ্জন কর্মকার। এক কুঠুরির সেই ঘরেই সাজানো রয়েছে পুরানো থেকে নতুন, একের পর এক রেডিওর মডেল। ১৯৬৭ সালে অমিতবাবুর বাবা দোকানটি চালু করেন যা আজও অমিতবাবু চালিয়ে যাচ্ছেন।
বুশ, মারফি, টেলিফাঙ্কেন, ফিলিপস থেকে শুরু করে এক সময়ের প্রায় সমস্ত বড়ো বড়ো ব্র্যান্ডের রেডিও তার দোকানে এখন বর্তমান। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি ১৯৪৪ সালের তৈরি। মহালয়ার কথা উঠতেই অমিতবাবুর বললেন, “এক সময়ে রাত তিনটে পর্যন্ত দোকানের বাইরে লাইন থাকত। কারণ ভোর চারটের সময় রেডিওতে মহিষাসুর মর্দিনী সম্প্রচার হবে। তার আগে রেডিও সারাতে না পারলে মহালয়াটাই মাটি।” তিনিও জানেন রেডিওর স্বর্ণযুগ হয়ত আর ফিরবে না। কিন্তু তাদের মতো কিছু পাগলের জন্যই হয়ত আজীবন বেঁচে থাকবে ঐতিহ্য, নতুনের ভিড়েও মাথা তুলে বাজবে রেডিও।
চিত্র ঋণ -কৌশিক দত্ত
Discussion about this post