রবীন্দ্রনাথকে দেখার বা বোঝার যেন আর শেষ নেই। তাঁর গানগুলিকে কি আদৌ পর্যায়-উপপর্যায়তে ভাগ করা যায়? অথবা ভাগ করার প্রয়োজন কি আছে? কিংবা রবীন্দ্রনাথের গানকে প্রেম-পূজা-প্রকৃতির বেড়াজালে কি বেঁধে রাখা যায়? এ বিষয়ে তর্ক হতে পারে দীর্ঘ। তর্কে জয়ী হবেন হয়ত যুক্তিপ্রেমী নীতিবাগীশরা। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতরে অথবা মনের ভিতরে প্রবেশ করলে শ্রোতা বা পাঠক বুঝবেন, এ সন্দেহ শেষ হওয়ার নয়। তেমনই একটি গান “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরের বাঁধনে।”
শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছোটবেলা থেকে মানুষ হয়েছে খুকু। ভাল নাম অমিতা সেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমেরই স্কুল কলেজের ছাত্রী সে। কিন্তু মারণ রোগে আক্রান্ত। ছোটবেলায় সে বেড়ে উঠেছে প্রকৃতির মাঝে। রবীন্দ্রনাথের ছত্রছায়ায়। প্রকৃতির মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ গান গেয়ে উঠেছে পাখির মত। রবীন্দ্রনাথ তার কাছে গান শুনতে খুব ভালবাসতেন। খুকু তার মৃত্যুর আগে কিছুদিন শান্তিনিকেতন আশ্রমে কিছুদিন ছিল। এই সময় সকাল-সন্ধ্যে সে গান শোনাত রবীন্দ্রনাথকে। কবি একের পর এক তাঁর পছন্দের গানের ফরমাশ করে যেতেন, খুকু গান গেয়ে যেত। একদিন অনেকের মাঝে খুকু গেয়ে উঠল, “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি।” গান শেষ হলে কবি তাকে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কীরে, গানটা শুনে তোর কি কিছু মনে পড়ছে?” খুকু কিছু না বলে হেসে উঠেছিল। সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করায় সেদিনই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “ওকে উদ্দেশ্য করেই গানটি আমি বেঁধেছিলাম।“ সকলে স্তম্ভিত হয়ে যায়। গুরুদেব বলেন কী!
পরে শৈলজারঞ্জন মজুমদারও বলেছেন, “খুকুকে স্নেহ করেই গানটি গুরুদেব ওর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন।” এখন প্রেম পর্যায়ের এই গানটি কে শ্রোতা কোন পর্যায়ে ফেলবেন? গীতবিতানের গানগুলি পড়লেও দেখা যাবে সেখানে কোন রচনাকাল নেই। গানগুলি সময়ক্রম অনুযায়ীও গোছানো নেই। যেন গুচ্ছাকারে কবির সারাজীবনের জীবনদর্শন ও চিন্তাগুলি সাজানো রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নির্দিষ্ট গানগুলির ক্ষেত্রেও তাই। এক জায়গা থেকে শুরু করে কোন অসীমে গিয়ে তাঁর ভাবনা যে ছড়িয়ে পরেছে,তা খুঁজতে যাওয়া অসম্ভব। তাই গানগুলিকে পর্যায়ের সীমানায় বেঁধে ফেলাও বোধহয় যায় না। খুকু কে যখন তাকে নিয়ে লেখা গানটি নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, খুকুও কিছুটা এমন কথাই বলেছিল, “এই গভীর অনুভূতি কি কোনো ছোট আধার ধারণ করতে পারে? ওঁর এই ভাব কোন গভীরে, কোন পরমার দিকে বয়ে যাচ্ছে, আমি তো উপলক্ষ মাত্র।”
চিত্র ঋণ – Wallpapercave
Discussion about this post