রেনেসাঁর উৎপত্তিস্থল ইতালিই কিন্তু ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিরও জন্মভূমি। একই সঙ্গে পৃথিবীর একাধিক দেশে ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান নতুন নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শক্তিশালী দেশগুলো আরো শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছে। পৃথিবীর ভূখন্ড বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। গ্রেটার ইভিল লেসার ইভিলের ধারণা সেই থেকে বাসা বেঁধেছে মানুষের চেতনায়। ঠিক এই কালপর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতালি গিয়েছিলেন দুবার। প্রথমবার ১৯২৫-এ এবং দ্বিতীয়টি ঠিক তার পরের বছর ১৯২৬-এ। ইতালির মাথার ওপর মুসোলিনির কালো ছায়া যমদূতের মতো চেপে বসেছে।
এইরকম সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মিলান নগরীতে একটি বিবৃতি পেশ করলেন — ‘People and nation’ । নেশন কী, নেশনের মানুষই বা কারা, যুদ্ধ কেন, কোথায় গলদ এ সবই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। রবীন্দ্রনাথ বলছেন – “সমস্ত পাশ্চাত্য সভ্যতার মূলেই এই গলদ। পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস ও ভীতিতে তাহারা বিরাট বিরাট সামরিক বাহিনী গড়িয়া প্রতিবেশী রাজ্যের দিকে শাণিত অস্ত্র উঁচাইয়া রাখিতেছে”।
ইতালির প্রচুর মানুষ প্রভূত উৎসাহের আতিশয্যে রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইতালির সর্বাধিনায়ক তখন মুসোলিনি। সরকার পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের আগমনকে কোনো পাত্তা দেওয়া হল না। স্বাভাবিক, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের নৈতিক বিরোধের জায়গা তো স্পষ্ট। সরকারের আচরণকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখলেন। এই সন্দেহ তারা প্রকাশও করলেন সাময়িক পত্র পত্রিকায়। সেই কারণেই কি রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বারের ইতালি ভ্রমণের চেহারা আমূল পাল্টে দিলেন বেনিতো মুসোলিনি! ইউরোপের শিল্পীদের স্বপ্নের ইতালি; দান্তে, লিওনার্দো, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর ইতালির ভয়ঙ্কর চেহারাটা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ঠাহর করতে পারেননি।
দ্বিতীয়বার ইতালি ভ্রমণ থেকে ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথ সুইজারল্যান্ডে দেখা করেন রমাঁ রোলাঁর সঙ্গে। যথারীতি ইতালি ভ্রমণ বিষয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। সরকার পক্ষ এইবার অসীম যত্নে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইতালি ঘুরিয়ে দেখায়। কবি যেখানেই গেছেন, যাঁর সঙ্গেই দেখা করেছেন ফ্যাসিস্ট অনুচররা তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। পরে অবশ্য কবি বুঝেছিলেন তাঁর স্বাধীন চলার পথে বাধা সৃষ্টি করাই ছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের লক্ষ্য। বিশ্বকবির সদ্ব্যবহার মুসোলিনি ভালোভাবেই করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে একনায়ক মুসোলিনির প্রশংসা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল ইতালিয় পত্র পত্রিকায়। রমাঁ রোলাঁর মতো আরো অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যে। বিশ্বকবিও ফ্যাসিস্ট শক্তির মুখোশ চিনতে পারেননি, তাঁর ভুল ভাঙাতে রমাঁ রোলাঁর সময় লেগেছিল। শ্রীমতী সালভাদোরি দুঃখের সাথে রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন “But what makes us unhappy that you have unintentionally helped to Fascism. We know it is unintentional, for you are too good to do so.”
Discussion about this post