প্রথম অ-ইউরোপীয় ব্যক্তি হিসেবে ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাপ্তির পর থেকেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন সারা দেশের উজ্জ্বলতম আইকন। তাই নোবেল জয়ের পর থেকেই, রবীন্দ্রনাথের মনে জাগে দেশের জন্য কিছু করার ভাবনা। সেই ভাবনার সূত্র ধরেই ১৯২১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে, নিজের খরচে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চালানো তো আর মুখের কথা নয়। তাই, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহের তাগিদে রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন পেশাদারী পথে হাঁটা। আর সম্বল বলতে তার অগাধ সৃষ্টিশীলতা। ১৯১০ এর দশকের শেষের দিক থেকেই দেশি-বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপনে খুঁজে পাওয়া যেত রবীন্দ্রনাথকে। তার অধিকাংশই প্রকাশিত হতো আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্যা স্টেটসম্যান, প্রবাসী, ক্যালকাটা গেজেট, তত্ত্ববোধিনী, এমনকি বিদেশে দ্যা গার্ডিয়ান এবং গ্লোবের মতো পত্রিকাতেও।

জালিয়ানওয়ালাবাগ কান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগের বছর কয়েক পর একটি বিদেশী পানীয় কোম্পানি তাঁকে বিদ্ধ করে একটি ট্যাগলাইনও তৈরি করেন। এতটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞাপন-জনপ্রিয়তা। বন্ধু হেমেন্দ্রমোহন বোসের অনুরোধে সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো!” আবার, পূর্ব ভারতীয় রেলের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছিল কবির শ্যামলী কাব্যের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন, ‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবিনি সম্ভব হবে কোনো দিন।’ ১৯২১ সালে দেশি কোম্পানির উৎপাদিত গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রথমবার বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় সচিত্র আত্মপ্রকাশ ঘোষণা করেন কবিগুরু। কবির শ্মশ্রুমন্ডিত ছবির সাথেই এই বিজ্ঞাপনে কবি লেখেন, ‘I know of no foreign soaps better than Godrej’s and I will make a point of using Godrej’s soap’.
বাঙালি ব্যবসায়ী হেমেন্দ্র মোহন বোসের কোম্পানিতে তৈরি তিনটি বিখ্যাত পণ্যের বিজ্ঞাপনে কবি লিখেছিলেন, “কেশে মাখো কুন্তলীন। রুমালেতে দেলখোস। পানে খাও তাম্বুলিন। ধন্য হোক এইচ বোস।” কলকাতার রেডিয়াম ল্যাবরেটরির উৎপাদিত, রেডিয়াম ক্রিমের বিজ্ঞাপনেও রবীন্দ্রনাথের দেখা মেলে। এই বিজ্ঞাপনে কবি লেখেন, ‘রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিম জাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোন পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।’ যদিও পরে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ নিজে কখনো এই ক্রিম ব্যবহার করেননি, টাকা পাওয়ার জন্যই এই বিজ্ঞাপন লিখেছিলেন তিনি।
তবে, রেডিয়াম ক্রিম, বোর্ন-ভিটা, জলযোগ মিষ্টির দোকান, বিখ্যাত ফটো স্টুডিও, ছাপাখানা, ঘি এবং দইয়ের কোম্পানি, এমনকি মস্তিষ্ক বিকৃতি রোগের মহৌষধ পর্যন্ত হরেক পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়া গেলেও, একটি কোম্পানিকে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেটি ছিল ‘ভারত’ ব্লেড কোম্পানি। এই কোম্পানিটি রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য এলে, কবি তার শ্বেতশুভ্র, দীর্ঘ দাড়িতে সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “এই দাড়ি নিয়ে আমি যদি বিজ্ঞাপন লিখি, তাহলে কেউ কি তোমাদের ব্লেডের ধারে আস্থা রাখবে? না আমাকে বিশ্বাস করতে পারবে?”
Discussion about this post