কালীপুজো মানেই শুধু দেবীর আরাধনা নয়। বরং, এটি আলো, রোশনাই, আনন্দ আর ভক্তির এক অপূর্ব মিলনমেলা। শ্যামাপূজার রাত্রে দেবী কালীর মন্ত্রোচ্চারণ মিশে যায় দীপশিখার দোলায়, ঢাকের ছন্দে আর ধুনুচির ধোঁয়ার লহরিতে। এই ধুনুচিই কালীপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ — আগুনে জ্বলতে থাকা নারকেল ছোবড়া, ধুনো আর ভক্তির আবেশে পুজোমণ্ডপকে করে তোলে এক পরম পবিত্র পরিসর। আর সেই ধুনুচি তৈরির কাজেই এখন পুরুলিয়ার মৃৎশিল্পীদের ঘরে ঘরে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।

পুরুলিয়ার কাশীপুরের নপাড়া গ্রামের কুম্ভকারপাড়া এখন যেন এক কর্মচঞ্চল শিল্পশালা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকার ঘূর্ণিতে নরম মাটি নিচ্ছে নানা আকার। রঞ্জিত কুম্ভকার, শ্রীমতি কুম্ভকার— এমন অনেক শিল্পীর ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে ধুনুচি। কেউ মাটি কেটে আনছেন পুকুরের ধার থেকে, কেউবা চাকার পাশে বসে নিখুঁত আকার দিতে ব্যস্ত। এক হাতে মাটির ভর, অন্য হাতে ছুরি, আর চোখে অদ্ভুত মনোযোগ— এমন দৃশ্যেই ভরে উঠেছে কুম্ভকারপাড়া।
ধুনুচি তৈরির প্রক্রিয়াটিও এক শিল্পের মতোই সূক্ষ্ম। প্রথমে মাটি ভালো করে কাদা করে নেওয়া হয়, তারপর চাকার ঘূর্ণিতে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে তার আকার। তৈরি ধুনুচিগুলো রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পর চলে যায় চুল্লিতে— আগুনে পুড়িয়ে মজবুত করা হয় প্রতিটি। শেষপর্যন্ত তুলির আঁচড়ে রঙের ছোঁয়া, কখনও লাল, কখনও হলুদ, আবার কখনও প্রাকৃতিক মাটির ছায়া— সব মিলিয়ে এক অনন্য সৃষ্টি।
তবু এই সৃজনের মধ্যেও রয়েছে দুঃখের সুর। আজকের দিনে ধুনুচির চাহিদা আগের মত আর নেই। বিশেষ করে পিতলের ধুনুচি বাজারে আসার পর চাহিদা হারিয়েছে মাটির ধুনুচি। তবুও পুরুলিয়ার মৃৎশিল্পীরা হাল ছাড়েননি। তাঁদের বিশ্বাস, যতদিন মানুষ মাটির গন্ধে ভক্তি খুঁজবে, ততদিন এই ধুনুচি থাকবে জীবন্ত ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে। মাটির গন্ধ, শ্রমের উষ্ণতা আর ভক্তির স্পন্দনে তৈরি এই ধুনুচি যেন কালীপুজোর আত্মা। তার ধোঁয়ার ধারে ধারে জেগে ওঠে এক অনির্বচনীয় আনন্দ, যেখানে মৃৎশিল্পীর পরিশ্রম আর ভক্তের অনুভূতি একাকার হয়ে যায়। কালীপুজোর পূর্ণতা যেন সত্যিই মেলে এই মাটির ধুনুচির আলো-ধোঁয়ার আবেশেই।
Discussion about this post