ভেনিসের লাল কার্পেটে পুরুলিয়ার অনুপর্ণা রায় হাতে নিলেন সেরা পরিচালকের ট্রফি। তাঁর বক্তৃতায় শত হাততালির শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল মুহূর্তের জন্য। একসঙ্গে উজ্জ্বল হলো বাংলা, পুরুলিয়া আর সমগ্র ভারতের চলচ্চিত্রের ইতিহাস আর সময়ের ইতিহাস। তাঁর সিনেমা “Songs of Forgotten Trees” এক জীবন্ত স্মৃতি, এক ভাঙা সময়ের নীরব প্রতিবাদ। যখন বাংলা সিনেমার বেশিরভাগটাই ব্যবসার দাপটে ক্লান্ত, গল্প নেই, সংবেদনশীলতাহীন, তখন অনুপর্ণার কাজ যেন অন্ধকারে আলোর রেখা। তিনি প্রমাণ করলেন যে, বাংলা সিনেমা এখনও আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের শিল্পের শক্তিতে বিশ্বকে থামিয়ে দিতে পারে।
পুরুলিয়ার মেয়ে অনুপর্ণা বড় হয়েছেন নিস্তব্ধ বন আর লালমাটির গন্ধে। উচ্চশিক্ষার জন্য আসা কলকাতায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের ছায়ায় তিনি শব্দের ভেতর খুঁজে পেয়েছিলেন ছবির ভাষা। পরে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (JNU) ফিল্ম স্টাডিজ পড়তে গিয়ে সিনেমার কারিগরি দিকগুলো আয়ত্ত করেন। তারপর পড়তে যাওয়া লন্ডন ফিল্ম স্কুলে। বাবা-মা এখনও পুরুলিয়াতেই থাকেন, সাধারণ জীবনের সরল ছন্দে; আর অনুপর্ণা, কলকাতা-লন্ডন-বার্লিনের ফ্লাইটের ভিড়ের মাঝেও, নিজের শেকড়ের গন্ধ বুকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। তাঁর প্রথম শর্ট ফিল্ম “Clay Dolls” যখন আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রশংসা পেয়েছিল। “Songs of Forgotten Trees” সেই অনুপর্ণারই পরিণত প্রকাশ যেন।
ভেনিসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে শুধু পুরস্কার গ্রহণ নয়, তিনি বলেছেন গাজার শিশুদের কথা, সেই রাতের কথা, যখন পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো ভূমিতে সবচেয়ে নতুন কবর খোঁড়া হচ্ছে। তাঁর চোখে জল ছিল, কণ্ঠে আগুন। পুরস্কার গ্রহণের পর সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার পর, তিনি “আরও বড় এবং ভয়াবহ বিষয়” সম্পর্কে কথা বলার কথা বলেন। তিনি বলেন, “প্রতিটি শিশুরই প্রাপ্য শান্তি, স্বাধীনতা ও মুক্তি। প্যালেস্টাইনও এর ব্যতিক্রম নয়।আমি এই কথার জন্য কোনো করতালি চাই না। এটি প্রশংসার বিষয় নয়, এটি আমাদের দায়িত্ব। আমাদের থামতে হবে, ভাবতে হবে এবং প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়াতে হবে”। তাঁর যে কথাটি শোরগোল ফেলেছেন, সেটি হল, বক্তৃতার মাঝেই তিনি বলেন, “আমি জানি, আমার এই কথাগুলো আমার দেশকে অসন্তুষ্ট করতে পারে, কিন্তু এখন সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়”। সবাই এক তরুণী বাঙালির কণ্ঠে মানবতার প্রতিবাদ শুনলেন। বাংলা সিনেমার গৌরবের সঙ্গে সঙ্গে, শিল্পের স্বাধীনতা ও সহানুভূতির শক্তিকেও নতুন উচ্চতায় তুলে দিলেন অনুপর্ণা রায়।
Discussion about this post