বিদ্রোহী কবি নজরুল লিখেছিলেন- “হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই, ভারতের দুই আঁখি।” তাঁর লেখা এই কবিতাই প্রমাণ করে সেই কবে থেকেই হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়ীকতার অন্যতম এক নিদর্শন আমাদের এই দেশ ভারতবর্ষ। দুই ধর্মের সম্প্রীতির সেই ছোঁয়া লেগে রয়েছে বাংলার গায়েও। এখানে রাম যেমন ঈদের বিরিয়ানি পেতে রহিমের দরবারে হাজির হয়, তেমনই তার সঙ্গে দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠে রহিমও। তবে শুধু পুজোর আনন্দ উপভোগই নয়, এই বাংলারই এক গ্রামে মুসলিমদের হাত ধরেই পূজিত হন মা কালী। অবিশ্বাস্য? না, বরং এটাই বাস্তব! আর ঘটনাস্থল বাংলার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার হিলি থানার অন্তর্ভুক্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত এক ছোট্ট গ্রাম, হাঁড়িপুকুর।
সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম হাঁড়িপুকুর প্রায় পুরোটাই মুসলিম অধ্যুষিত। তবুও দেশভাগের পর থেকেই হাঁড়িপুকুর গ্রামের সীমান্তে পূজিত হয়ে আসছেন দেবী কালী। যদিও মন্দিরে হিন্দু মতে সারাবছরই পুজোর দায়িত্বে থাকেন হিন্দু এক পুরোহিতই। তবে পুজোর যাবতীয় ভার এসে পড়ে সেই এলাকারই মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর। এমনকি যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণও করেন তাঁরা। কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দী গ্রামবাসীদের চেষ্টায় সারাবছরই আলোয় সেজে ওঠে সেই কালী মন্দির। পুরোনো রীতি অনুযায়ী হিন্দু পুরোহিত এই পুজো করলেও আদতে তা নিজেদেরই পুজো বলে মনে করেন সেই এলাকার মুসলিম গ্রামবাসীরা।
কোনও দেবী মূর্তি না, মন্দিরটিতে পূজিত হয় ঘট। তবে শুধু গ্রামবাসীরাই নয়, পুজোর আনন্দে গা ভাসাতে হাজির হন সীমান্তে প্রহরারত বিএসএফ জওয়ানরাও। এমনকি বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বিজিবিও সামিল হয় সেখানে। কালীপুজোর দিন খিচুড়ি ভোগেরও আয়োজন করা হয়। ভেদাভেদ ভুলে তাই ভাগ করে খান সবাই। উৎসবের রেশ চলে হাঁড়িপুকুর সংলগ্ন আশেপাশের গ্রামগুলিতেও।
তবে আসন্ন কালীপুজোতে করোনা পরিস্থিতির জেরে হয়তো মিলনমেলায় পরিণত হবে না সেই গ্রাম। তবে সুদিনের স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি? আশা করাই যায়, ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে জেগে উঠবে হাঁড়িপুকুরের সকল মানুষ। তাদের এই পারস্পরিক সম্প্রীতির নিদর্শনই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আজও হয়তো ‘ধর্ম’ বলতে জাত-ভেদাভেদ মুছে মানুষ শুধু মানুষকেই বোঝে। হাঁড়িপুকুরের বাসিন্দারা তার-ই প্রকৃত উদাহরণ।
Discussion about this post