সময়টা ১৪৮০ সাল। তাহিরপুরের রাজা পন্ডিতগণকে আমন্ত্রণ করলেন রাজসভায়। রাজার ইচ্ছে অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করবেন। সেই উদ্দেশ্যেই পন্ডিতগণের কাছ থেকে নিয়ম কানুন,বিধি পরামর্শ নেওয়া। রাজা জানালেন তাঁর মনের ইচ্ছে। তবে পন্ডিতরা তা নাকচ করে দিলেন প্রথমেই। তাঁরা বললেন কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞের বিধান শাস্ত্রে নেই। এ কথা শুনে রাজার মন যথার্থই খারাপ হল। এরই মাঝে পন্ডিত রমেশ শাস্ত্রী বললেন, “তবে একটি উপায় আছে।” শাস্ত্রী মশাই রাজাকে দুর্গা পুজোর পরামর্শ দিলেন। দেবী দুর্গতিনাশিনীর পুজো নিজেই এক মহাযজ্ঞ। এতে সমস্ত মহাযজ্ঞের সমান ফল পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, যে কোনো যুগে যে কেউ করতে পারেন এই পুজো। রাজা তো যারপরনাই ভীষণ খুশি। তিনি আদেশ করলেন তবে রমেশ শাস্ত্রীর কথা মতো মহিষাসুরমর্দিনীর পুজোই আয়োজন করা হোক আশ্বিন মাসে।
সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে রাজবাড়ির মূল ফটকের কাছেই স্থাপন করা হল বেদী। সেখানেই আয়োজন হল মহাযজ্ঞের। তাঁর পাশেই রাজা নির্মাণ করলেন মন্দির। এই রাজা হলেন কংস নারায়ণ। তৎকালীন তাহিরপুরের রাজা। সম্রাট আকবরের আমলে বাংলার ‘বারো ভুঁইয়া’র এক ভুঁইয়া। পাঠান আমলে যিনি ছিলেন ফৌজদারের ভূমিকায়। রাজা কংস নারায়ণই বাংলায় শারদোৎসবকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন সর্বসাধারণ কাছে। এর আগে বাংলায় মহাশক্তির আরাধনা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু এই প্রথম কোনো রাজবাড়িতে আয়োজন হল দুর্গাপুজোর। সেই পুজো ছিল দেখবার মতই। আয়োজন এবং আড়ম্বরে সামান্য সমান ফাঁক থাকলেও চলবে না। পুজোয় ব্যয় হয়েছিল তৎকালীন প্রায় সাড়ে আট লক্ষ টাকা! এতদিন শুধুমাত্র কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণেই বাঙালি পড়ে এসেছিল অকাল বোধনের কথা। আর এবারে রাজা কংস নারায়ণের সৌজন্যে সচক্ষে দেখল অকাল বোধন, আধুনিক দুর্গাপুজো। তবে সেই রাজাও এখন নেই, সেই রাজবাড়িতে নেই তাঁর বংশধররাও।
আরও পড়ুন টাঙ্গাইল ঘুরে বেলাকোবা! বাঙালির মিষ্টি সফরে এক বিশ্বস্ত সঙ্গী সেই চমচম
কংস নারায়ণের পরবর্তী চতুর্থ রাজা লক্ষ্মী নারায়ণ রায়ের আমলে রাজবাড়িতে হামলা করে বাংলার সুবেদার শাহ সুজার সৈন্য দল। তখন দিল্লির মসনদে ঔরঙ্গজেবের শাসন। শাহ সুজার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় রাজা কংস নারায়ণের আদি রাজপ্রাসাদ। ১৮৬২ সালে পরবর্তী রাজা বীরেশ্বর রায়ের স্ত্রী জয় সুন্দরী দেবী পুনরায় নতুন করে নির্মাণ করেন রাজবাড়ি সহ দুর্গা মন্দির। মন্দিরের সঙ্গে নির্মিত হলো নামফলক। বর্তমানে সেটি বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সুরক্ষিত। বারনই নদের তীরে অবস্থিত এই রাজপ্রাসাদও এককালে পরিত্যক্ত হয়। রাজবংশের শেষ রাজা ছিলেন শিব শেখরেশ্বর রায়। যদিও তাঁর পিতা শশী শেখরেশ্বর রায়ের সময় থেকেই রাজ পরিবারের লোকেরা কলকাতায় তৈরী করেন তাঁদের নতুন ঠিকানা। একসময় তাঁরাও তাহিরপুর রাজবাড়ীতে যাতায়াত বন্ধ করে দেন। এই তাহিরপুরই আজ লোকমুখে তাহেরপুর। ১৯৬৭ সালে রাজবাড়িটি তাহেরপুর ডিগ্রি কলেজে পরিণত হয়। অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার অন্তর্গত বাগমারা উপজেলায় অবস্থিত তাহেরপুর। এখনও আছে এই দুর্গামন্দির। স্থানীয় সংসদ এনামুল হকের উদ্যোগে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সম্পন্ন হয় মন্দির পুনঃনির্মাণের কাজ। এই মন্দিরেই সূচনা হয়েছিল বাঙালির সেরা দুর্গোৎসব। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি জাতির সংস্কৃতি ও ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো পুরনো হওয়ার নয়!
Discussion about this post