সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই পরিবেশ ও প্রাণীজগৎ একসূত্রে গাঁথা। পরিবেশ জীবকূলকে উজাড় করে দিয়েছে তার ভূমি, জল, বায়ু। তবে আধুনিকতার ধাক্কাতে পরিবেশ হারিয়ে ফেলছে তার গুণগত সত্ত্বা। যার জেরে যে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনজীবন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ হাওড়ার সাঁকরাইল অঞ্চল। স্থানীয় এক সিমেন্ট কারখানার মাত্রাতিরিক্ত দূষনের কারনে ক্ষতিগ্রস্ত মহিষগোট, ভগবতীপুর ও চতুর্ভূজকাটি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার গ্রামবাসী। ২০০১ সালে সাঁকরাইলের জলাধুলাগড়ি গ্রামে একটি সিমেন্ট কারখানা নির্মাণ করে অম্বুজা সিমেন্ট লিমিটেড। কারখানা শুরুর সময়ে তা ১ MMTPA উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে শুরু হলেও, পরবর্তীতে ২০০৮ ও ২০১১-য় পর্যায়ক্রমে ১.৫ MMTPA এবং ২.৪ MMTPA সিমেন্ট উৎপাদন করার ছাড়পত্র পায় কারখানাটি। ফলে কারখানা থেকে নিঃসৃত দূষকের পরিমানও ক্রমশঃ বেড়ে চলে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, কারখানা নির্মাণের সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু তারপর প্রায় ২০ বছর কেটে গেলেও কোন স্থায়ী কাজে স্থানীয়দের জায়গা নেই। এছাড়া কারখানা থেকে উড়ে আসা বর্জ্যের কারণে ক্রমশ কমে যাচ্ছে গ্রামের ফসলের গুণমান, বিষক্রিয়ার কারণে মারা যাচ্ছে পুকুরের মাছ। অন্যদিকে, ধীরে ধীরে প্রবীণ ব্যক্তিদের পাশাপাশি শিশুদের মধ্যে দেখা যেতে শুরু করছে বিভিন্ন শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা। দেখা দিচ্ছে ত্বকের বিভিন্ন রোগও। স্থানীয়দের মতে, বহুবার কারখানা কর্তৃপক্ষকে এই সমস্যার কথা জানিয়েও কোন সুরাহা হয়নি। ফলে ২০১৯ সালে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে গঠিত হয় মহিষগোট চতুর্ভুজকাটি ভগবতীপুর পরিবেশ সুরক্ষা কমিটি।
সময়ের সাথে বাড়তে থাকে কমিটির আন্দোলনের ঝাঁজ। মিছিল- সভা, পোস্টারিং ও ডেপুটেশনের পাশাপাশি জাতীয় সবুজ আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয় কমিটির তরফ থেকে। ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল এই অভিযোগের ভিত্তিতে একটি কমিটি গড়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। কমিটিতে রাখা হয় জেলাশাসক, রাজ্য ও কেন্দ্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও আন্দোলনকারী গ্রামবাসীদের ১ জন করে প্রতিনিধি। ২৪ ঘন্টার জন্য দূষণ পরিমাপক যন্ত্র বসানো হয়। ৩/৩/২২ তারিখে সেই যন্ত্রের তথ্য প্রকাশ করে কমিটি জানায় – “PM 2.5 এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭ গুন ও PM 10 প্রায় ১৪ গুণ বেশি। এই পরিমাণ দূষক শ্বাসবায়ুতে মিশে থাকলে তার পরিনাম প্রাণঘাতী রোগ।” কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী কারখানার কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ টাকার অঙ্কে প্রায় ৬,০৩,২৮,০৮৩ টাকা।
ন্যাশনাল গ্রীন ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে ৪ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছেন। সেই সিদ্ধান্তের দিকেই তাকিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন গ্রামবাসীরা। আন্দোলনের পরিচিত মুখ ও স্থানীয় চিকিৎসক বসুদেব বরের মতে, “সিমেন্ট কারখানা ও বসতির মধ্যে যে ন্যূনতম দূরত্ব হওয়া উচিত তা এক্ষেত্রে মানা হয়নি। কারখানার পাঁচিল ও বসতির মধ্যে দূরত্ব ৫০ ফুটেরও কম। যার ফলে কারখানা সংলগ্ন অঞ্চলগুলির চাষাবাদ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগে ১ বিঘা জমিতে ১৮-২০ মণ ফসল হলেও বর্তমানে তা ১২-১৪ মণে নেমে এসেছে। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই ত্বক ও শাসকষ্ট জনিত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তবে আমরা শিল্পের বিরুদ্ধে নই। আমরা চাই কর্তৃপক্ষ কারখানার দূষণের পরিমাণ যেন কিছুটা কমানোর চেষ্টা করেন।”
Discussion about this post