আজ থেকে ২৯ বছর পর আমরা নিজেদের কোন জায়গায় দেখতে চাই? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো সকলেরই তৈরী। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, আজ থেকে ২৯ বছর পর পৃথিবী কোন জায়গায় থাকবে? আপনি থমকে যেতে বাধ্য। আর সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জ এই প্রশ্নের যা উত্তর দিয়েছে, তা নাড়িয়ে দিয়েছে মানব সভ্যতার ভিত! ২৯ বছর পর আর একফোঁটাও জল পাবে না ভারত সহ বিশ্বের ৫০০ কোটিরও বেশি মানুষ, এমনটাই আশঙ্কা তাঁদের। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ ‘ওয়ার্ল্ড মেটিরিওলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও)’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্টের ‘দ্য স্টেট অব ক্লাইমেট সার্ভিসেস ২০২১: ওয়াটার’ শিরোনামে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে স্বাভাবিকভাবেই তৎপর হয়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রতিটি দেশের রাজা-প্রজা সকলেই। সেই দলে সামিল হয়েছেন উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও অধ্যাপক ড. তাপস পালও। তাঁর চিন্তাধারা ও কর্মসূচীর ব্যতিক্রমী চরিত্র এই কঠিন সংগ্রামকে ইতিমধ্যেই এগিয়ে দিয়েছে বেশ কয়েক পা।
রায়গঞ্জের ভূমিপুত্র পেশায় ভূগোলের অধ্যাপক তাপসবাবুর ডেইলি নিউজ রিলকে জানালেন তাঁর সুচিন্তিত মতামত। তাঁর মতে, বিশ্বের জলবায়ু কিন্তু পরিবর্তিত হচ্ছে না – বরং মানুষের অপরিণামদর্শী ক্রিয়াকলাপে জলবায়ু আজ বিপন্ন। বছর তিনেক আগে আমাজনের জঙ্গলে একটি গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, পানীয় জল ও অক্সিজেন নিকট ভবিষ্যতে তৃতীয় ও চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে! সচেতনতা গড়ে তোলার পাশাপাশি তিনি নিজেও পরিকল্পনা করেন, এক বছরের মধ্যে হাজারটি বট ও পাকুড় গাছ তিনি রোপণ করবেন কুলিক নদীর তীর বরাবর। তাঁর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অধ্যাপক ড. অরিন্দম দত্ত, গবেষক জয়জিৎ দেবনাথ, ছাত্র স্নেহাশিস, জিতেন্দ্র, ধীরজ সহ বহু পরিবেশ-বন্ধু। কুলিকের উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এই ১০০০টি গাছ লাগানোর জন্য ২০ জনের একটি দল গঠন করেছেন তাপসবাবু। প্রতি মাসে রোপণ করা হবে ৮৪টি গাছের চারা। বিভিন্ন দেওয়াল, প্রাচীর, বাড়ি বা ছাদের কোণে নিজের মত বেড়ে ওঠা চারাগুলিই সংগ্রহ করে এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে।
কিন্তু কেবল বট-পাকুড়ই কেন? ‘ডেইলি নিউজ রিল’-এর সাথে কথোপকথনে সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তাপস বাবু। তাঁর কথায়, “সারা পৃথিবী এখন চাইছে সবুজ পরিবেশ তৈরী করতে। কিন্তু এই সবুজায়নেরও রয়েছে প্রকারভেদ। একদিকে রয়েছে ‘আরবান গ্রীন’ অর্থাৎ শহরের কৃত্রিম পরিবেশে টবে লাগানো গাছ। অন্যদিকে রয়েছে ‘রুরাল গ্রীন’ অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা গাছ। ভেবে দেখবেন, পরিবেশের ওপর কিন্তু এই দুই প্রকার সবুজায়নের প্রভাব আলাদা। ফলে খাতায়-কলমে হাজার হাজার বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী পালিত হলেও, ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না ‘অ্যাকচুয়াল গ্রীন’-এর। তাছাড়া পরিবেশের স্বার্থে দরকার এমন গাছ রোপণ, যা দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে সক্ষম। বট ও পাকুড় গাছের গড় আয়ু ২০০-৩০০ বছর, আয়তনেও প্রায় ৫টি অন্যান্য গাছের সমান। ভৌমজল বৃদ্ধিতে পরশপিপুল ও নিমগাছের পরেই বটগাছের স্থান। আবার পাকুড় হল পৃথিবীর একমাত্র গাছ, যা ২৪ ঘন্টাই অক্সিজেন সরবরাহে সক্ষম! প্রাকৃতিক দুর্যোগে নদীর পাড় রক্ষা করবে এই গাছই।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি একদিকে খুলে দিয়েছে ধ্বংসের পথ। অন্যদিকে সেই বিজ্ঞানই পারে পৃথিবীকে রক্ষা করতে। তাই এই ধরণের বিজ্ঞানসম্মত ও পরিকল্পনা মাফিক কর্মসূচী গ্রহণই বিশ্বকে পুনরায় শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার একমাত্র রাস্তা। ইতিমধ্যেই কুলিকের তীরে ১০০০ টির মধ্যে রোপণ হয়ে গিয়েছে প্রথম ১৫ টি গাছ, বাকিটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
Discussion about this post