বিজ্ঞানচর্চা, তাও নাকি বাংলায়? আজকের কথা নয়, এই ব্যঙ্গ ও অপমানের ইতিহাস বহু পুরোনো। তাতে যদিও এতটুকুও দমে যাননি বাংলার বিজ্ঞানীরা। বরং প্রত্যুত্তরে একের পর এক রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিশ্বপরিচয়’ থেকে শুরু করে রমেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘জিজ্ঞাসা’, জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’, জগদানন্দ রায়ের ‘বৈজ্ঞানিকী’, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘নব্যবিজ্ঞান’ ইত্যাদি। আজ, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও বাঙালি তথা ভারতীয় বিজ্ঞানীরা কিন্তু ভুলে যাননি সে ইতিহাস! তাই বিশ্বের দরবারে নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিলেন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মাধ্যমেই। স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করেই এবার নব-আবিষ্কৃত প্রজাতির নামকরণ করলেন নদীয়ার বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কৃষ্ণ কর্মকার ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা!
বিজ্ঞানসম্মত নামকরণের নিয়ম হল, তা হতে হবে ল্যাটিন ভাষায়। তবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এগ্রিকালচারাল এন্টোমোলজি’ তথা কৃষি কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কর্মকার কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো নিয়মভঙ্গ করেননি। স্থানীয় ভাষার শব্দকেও কিছু নিয়ম মেনে ল্যাটিন শব্দে রূপান্তরিত করা সম্ভব। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে সম্পন্ন হয়েছে একের পর এক অসামান্য নামকরণ! যেমন, ঐতিহ্যবাহী গোর্খা অস্ত্র ‘খুকরি’-র নামানুসারে উত্তরবঙ্গে আবিষ্কৃত একটি মাইটের নামকরণ হয়েছে ‘Floridotarsonemus Kukri’! গবেষণা চলাকালীন গোর্খা জনজাতির মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হন অধ্যাপক ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। তাই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই সিদ্ধান্ত! এই খবর পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই খুশি হয়েছেন সেই মানুষগুলিও।
এই মাইটের আবিষ্কর্তা হলেন ড. কর্মকারের ছাত্র প্রিয়ঙ্কর মণ্ডল। ছাত্রী সাগরিকা ভৌমিকের আবিষ্কার Amblyseius Parbatabasi। নামকরণের কারণ, এই মাইটটি কেবল পাহাড়ি অঞ্চলেই পাওয়া যায়! ত্রিপুরার রাজা বীরবিক্রমের নামানুসারে ছাত্রী অনামিকা করের আবিষ্কৃত মাইটের নাম Phytoseius birbikrami। Steneotarsonamus Amlisoae মাইটটি আবিষ্কার করেছেন ছাত্রী মৌমি গাঙ্গুলী। নেপালে স্থানীয়রা Broom Grass-কে বলেন ‘amliso’। সেই গাছ থেকেই আবিষ্কার হয় এই মাইট। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য বাদুড়ের কানের সাথে সাদৃশ্য অনুযায়ী Metatarsonemus Badurkani, কাঁঠালের পাতা থেকে আবিষ্কৃত প্রজাতি Floridotarsonemus Kathali ইত্যাদি!
এই অভিনব ভাবনার নেপথ্য কারণটি ‘ডেইলি নিউজ রিল’-এর সাথে ভাগ করে নিয়েছেন ড. কর্মকার। তাঁর কথায়, “নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রজাতির বিজ্ঞানসম্মত নাম দেশ-ভাষা-সময় নির্বিশেষে এক ও অপরিবর্তনীয়। একটি জীব, সে পৃথিবীর বুকে থাকবেই। তাই তার নামটাও থেকে যাবে। বহু যুগ পরেও যখন মানুষ নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করবেন, তখন আগের থেকে নতুনটিকে আলাদা করার জন্য আগে আবিষ্কৃত প্রজাতিটির সন্ধান করতেই হবে। তাই বিজ্ঞানসম্মত নামের মাধ্যমে আসলেই মানুষ, স্থান, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে অমর করে তোলা সম্ভব! আমরাও তারই চেষ্টা করেছি।” প্রকৃত শিক্ষা যে মানুষকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে, তা আবারও প্রমাণ করে দিলেন অধ্যাপক কর্মকার ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা!
Discussion about this post