ভারতীয় জনজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ভারতীয় রেলব্যবস্থা। এই রেলের ১৭৮ বছরের ইতিহাসের পাতা ঘাটলে পাওয়া যাবে উত্থান ও পতনের নানা কাহিনী। রেলওয়ে, ডাক ও টেলিগ্রাফের ভারতে অনুপ্রবেশের জন্য লর্ড ডালহৌসির অবদান ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার মূলত ইংরেজরা নিজেদের সুবিধার্থেই চালু করেছিলেন। সেই সময় ইংরেজদের পাশবিক ও মানবিক অত্যাচারের ফলে সমাজে বিক্ষোভ দানা বাঁধে, ফলে স্বদেশীয়ানার সঞ্চার ঘটে। এই সময় উদ্যোগ ওঠে বিদেশি পণ্য বয়কটের। বিদেশি পণ্য বয়কটের সাথে সাথে বিদেশি রেলপথও ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন স্বদেশীরা। এই অঙ্গীকার নিয়েই ১৮৯৪ সালে চালু হয় বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেল।
বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেল (বিপিআর) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল ভারতের প্রথম প্রাইভেট রেলপথ, যার নির্মাতা ছিলেন একজন ভারতীয়। রেলপথটি তারকেশ্বর থেকে ত্রিবেণী ও বর্ধমানের জামালপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার। এই রেলপথটির উদ্যোক্তা ছিলেন হুগলির ধনেখালির সিতি পলাশী গ্রামের বাসিন্দা অন্নদাপ্রসাদ সিংহ রায়। তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী এবং সমাজসেবী। তিনি এবং আরো কয়েকজনের মিলিত প্রচেষ্টায় শুরু হওয়া রেলপথ তৎকালীন বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটায়। এর ফলে বাংলায় অনেক ব্যবসায়িক সম্প্রসারণও ঘটে। ১৮৯০ সালে ‘বেঙ্গল প্রিভিন্সিয়াল রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড’ রেজিস্ট্রি হবার পরে কোম্পানির চিফ ইঞ্জিনিয়ার অন্নদাপ্রসাদ রায়ের তত্ত্বাবধানে তারকেশ্বর থেকে মগরা রেলপথের জন্য জমি সংগ্রহ ও রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হয়।
১৮৯৫ সালে তারকেশ্বর থেকে মগরা পর্যন্ত প্রায় ৫২ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে এই রেলের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। জানা যায়, প্রায় ১১ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল এই রেল প্রকল্পে। এরপর ১৯০৪ সালে ত্রিবেণী পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটার সম্প্রসারিত করা হয় এই রেলপথটি। এই রেলপথে কানানদী, ঘিয়া, কানা দামোদর ও কুন্তী নদীর ওপর চারটে সেতু তৈরি করতে হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে তারকেশ্বর থেকে ত্রিবেনী পর্যন্ত হয় ৩৩ টি স্টেশন। পথে রেলস্টেশনগুলি ছিল – চৌতারা, দশঘড়া, তারকেশ্বর, ভাস্তাড়া, ধনিয়াখালি, সুলতানগাছা, মগরা, দ্বারবাসিনী এবং ত্রিবেণী ইত্যাদি। সেই সময় জংশন স্টেশন ছিল দশঘড়া। পরে ১৯১৭ সালে রেলপথের একটি শাখা দশঘড়া থেকে জামালপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। এই পথের রেলস্টেশনগুলি ছিল – চৌতাড়া, শুকপুর, গোপিনগর, শ্রীকৃষ্ণপুর, চকদীঘি এবং সিদ্ধেশ্বরী।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর বিপি আর ভারতীয় রেলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তবে বর্তমানে এই রেলপথ বিলুপ্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৬ সালে এই রেলপথ পরিত্যক্ত হয়। দীর্ঘ অবহেলায় রেলপথ ও রেলস্টেশনগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফলে ধীরে ধীরে অন্নদাপ্রসাদ ও কতিপয় বাঙালির এই কৃতিত্ব বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। কিন্তু দশঘড়া শ্রীকৃষ্ণপুরে এখনও আছে রেলের সেই টিকিট কাউন্টারটি। বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল রেল ছিল ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ২০০৯-১০ রেল বাজেটে এই রেলপথের পুনরুজ্জীবনের জন্য ৩৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন এখনও পর্যন্ত সম্ভবপর হয়নি।
Discussion about this post