১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। স্বাধীনতাকামী বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত ভারতবাসীর একবুক গর্বের দিন। চলতি বছরে ভারতবাসী স্বাধীনতার ৭৭তম বর্ষপূর্তি উদযাপনে সামিল হলেন। শুধুমাত্র এই দিনটিকে ঘিরে কত কোটি ভারত মায়ের সন্তান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আমরা সকলেই কখনও জনশ্রুতির মাধ্যমে, কখনও ইতিহাসের প্রতিটি পরতে ব্যক্ত ঘটনাবলীর মাধ্যমে জেনেছি। তাই ১৫ই আগস্ট দিনটিতে ভুলিনি তাদের স্মরণ করতেও। কিন্তু যাঁদের কেউ খোঁজ রাখেনি বা বলা বাহুল্য মনে রাখেনি? হ্যাঁ, তেমনই এক বঙ্গসন্তান তথা বিপ্লবী অন্দোলনের পথিকৃৎ হলেন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র ওরফে পি মিত্তির। শিয়ালদহ নৈহাটি জংশনের সঙ্গে বেশ কয়েকজন মনীষীর নাম যেমন জড়িয়ে রয়েছে তেমন জড়িয়ে রয়েছে পি মিত্তিরের নামও। নৈহাটি পুরসভা প্রাঙ্গণে রয়েছে তাঁর একটি মূর্তিও। তিনি আসলেই ছিলেন বাংলায় বিপ্লবী গড়ার কারিগর।
অসম্ভব জেদী, আত্মবিশ্বাসী এবং নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকার মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন তিনি। বিদেশ থেকে পড়াশোনার পর দেশে ফিরে হতে হয়েছিল একঘরে। সমাজ তার বাড়িসুদ্ধ সকলকে খ্রিস্টান হতে বাধ্য করতে পারলেও তাঁকে কোনোভাবেই পারেনি। এমনকি খাঁটি হিন্দুমতে স্বধর্মের মেয়েকেই বিয়ে করবেন বলে জেদ ধরেছিলেন এবং সেই জেদ থেকে তথাকথিত সমাজও তাঁকে টলাতে পারেননি। প্রকৃতির দিক থেকে এটাই ছিল তাঁর দাপট। বিখ্যাত নরমপন্থী নেতা সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গী ছিলেন বটে, কিন্তু নরমপন্থী আদর্শে তাঁর বিশ্বাস ছিল না কোনদিনই।তিনি বলতেন যে কাগজ লিখে, লোক জানিয়ে বিপ্লব হয় না, তার জন্য গোপনে সাধনা করতে হয়। তাই নিজে অস্ত্র জোগাড় করে স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন সারা দেশ গর্জে উঠবে ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
দেশে ফিরেছিলেন ব্যারিস্টার হয়ে। স্বাভাবিক নিরাপদ জীবনের আকাঙ্খা কোনদিনই করেননি তিনি। লাঠি খেলা, তলোয়ার চালানো এসবের পাশাপাশি একদল তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান অনুশীলন সমিতি। তাঁর কথায়, তলোয়ার খাপ থেকে বেরিয়ে গেছে, হয় তা শত্রুর বুকে ঢুকবে আর নয়তো আমাদের বুকে। তীক্ষ্ণ জ্বালাময়ী বাণীতে জন্ম নিল বিপ্লবী মনোভাবের একদল ছেলেরা যাদের মনে ছিল একটাই কথা–’বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। আইনজীবী হবার সুবাদে অনেক রাজনৈতিক মামলা তিনি লড়েছেন বিপ্লবীদের হয়ে। বড়বাজারে পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের ছাড়াতে থানায়ও যান তিনি। পুলিশ তাঁর ওপর কড়া নজরদারি করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কখনই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারেননি।
১৯১০-এ ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রধান পুলিনবিহারী ও তাঁর সঙ্গীরা ঢাকায় গ্রেফতার হওয়ার পরেই তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার এক মাসের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। একটু সামলে ওঠার চেষ্টা করলেও শেষরক্ষা আর হয়নি। এক সপ্তাহের মধ্যে আবার একবার হার্ট অ্যাটাক কেড়ে নিল তাঁর মত একজন সশস্ত্র বিপ্লবীকে। মৃত্যুর আগে অবধিও নিজের হাতে তৈরি করা অনুশীলন সমিতি এবং তার ছেলেদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখে গেছিলেন। বলেছিলেন, “I feel my end is approaching. Do convey to my dear Pulin and my other Dacca boys now undergoing trial, that my last thoughts are with them.” আজ ইতিহাসের পাতায় তাঁর উল্লেখ থাকে ঠিকই কিন্তু কজনই বা মনে রেখেছে তাঁর অবদানের পুঙ্খানুপুঙ্খতাকে!
Discussion about this post