ভারতের একসময়ের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল কালিকট। মালাবার উপকূলে এক খন্ড অমূল্য রত্নের মত ছোট্ট বন্দর এটি। ব্যবসায়িক দিক দিয়ে কালিকট বন্দরকে চিনত গোটা বিশ্ব। একসময়ে নৌ-শক্তিতে সুপার পাওয়ার পর্তুগালের নজর পড়ল এই বন্দরে। ১৪৮৭ সালে রাজা দ্বিতীয় জন গুপ্তচরের মাধ্যমে বন্দরটি সম্পর্কে খোঁজ নেন। এর প্রায় ১০ বছর পর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ার উদ্দেশ্যে ১৪৯৭ সালে ভাস্কো-দ্য-গামা চারটি জাহাজ সাজিয়ে রওনা হন। ভাস্কো দ্য গামা ইবনে মজিদ নামে এক বিখ্যাত আরবীয় সমুদ্র বিজ্ঞানীর খোঁজ পান। মজিদ নামের ওই ব্যক্তিই পথ দেখিয়ে ভাস্কো দ্য গামাকে এদেশে নিয়ে আসেন।
ইতিহাসের পাতায় ভাস্কো দ্য গামাই প্রথম জলপথে ভারত আসার সফল নায়ক ছিলেন। ১৪৯৮ সালে ২০ মে দক্ষিণ উপকূলে কালিকটের কাছে প্রথম পা রাখেন তিনি। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রথম বীজটি রোপিত হয় সেই সময়ই। এখানকার বসবাসকারী সাধারণ মানুষ কখনোই কামান তথা কামান সজ্জিত জাহাজ দেখেননি। যাই হোক, ভাস্কো দ্য গামা কালিকটের রাজা জামোরিনের কাছে এই বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য করার অনুমতি চান। কামান সজ্জিত জাহাজ দেখে রাজা ভয় পেয়ে যান এবং বাণিজ্য করার অনুমতি দিতে বাধ্য হন। এই সময় ভাস্কো দ্য গামা একটি অন্যায় দাবী করে বসেন। বাণিজ্য করার জন্য তাদের পণ্য শুল্ক মুক্ত করতে হবে বলেন তিনি। অন্যদিকে এই বন্দরের সঙ্গে আরব বণিকদের এক ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সখ্যতা গড়ে উঠে। সেটিকে ভাস্কো দ্য গামা ভালো চোখে দেখলেন না। পর্তুগীজদের প্রাথমিক ধারণা ছিল এদেশের মানুষ হয়ত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হবেন। কিন্তু এখানে এসে তিনি দেখলেন তারা বেশিরভাগই হিন্দু-মুসলমান। দেশে ফিরে প্রাথমিক সফরের সমস্ত খুঁটিনাটি রাজা ডেমো ম্যানুয়েলকে জানালেন তিনি। কালিকটে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে স্থানীয় নিরীহ জনগণকে বিতারিত করতে হবে বলেও জানান।
এবার দ্বিতীয়বারের জন্য ৩৩ টি জাহাজ এবং ১৫০০ জন যোদ্ধাকে নিয়ে পর্তুগীজরা এলেন কালিকটে। সেখানে রাজার কাছে একটি বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের অনুমতি চাওয়া হল। কিন্তু পর্তুগীজদের উদ্দেশ্য ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভাস্কো দ্য গামার মনোবাসনা ছিল লোভ এবং লাভের আশায় এগোতে থাকা। তার ফলে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে পর্তুগীজ বাহিনীর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকল। পর্তুগীজরা কামানের গোলার সাহায্যে কালিকট বন্দরে আক্রমণ হানে। তারপর রাজা জামোরিনের বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে পর্তুগীজরা জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যায়।
কিন্তু পর্তুগীজরা যে এত সহজে দমবার পাত্র নয়। ১৫০২ সালে ফের ২০ টি জাহাজ আর ৮০০ যোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করে তারা। এরপরই শুরু হয় ভাস্কো দ্য গামার বিভীষিকাময় ধ্বংস যুদ্ধের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেই তিনি যে জাহাজেরই দেখা পান, লুটপাট ও ধ্বংস করতে থাকেন। মক্কা থেকে হজ যাত্রীদের নিয়ে কয়েকটি জাহাজ ফিরে আসছিল। সেগুলিও নিস্তার পেল না তাঁর হাত থেকে। সব ধনসম্পদ লুঠ করে জাহাজগুলিতে আগুন দেওয়া হয়। কালিকট পৌঁছনোর আগেই এই নিষ্ঠুরতার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই কালিকটের রাজার বাহিনীর সঙ্গে পর্তুগীজদের চরম যুদ্ধ বেধে যায়। তারা ভারতীয় জাহাজ আটক করে নাক, কান, হাত কেটে অপমানের প্রতিশোধ স্বরূপ রাজা জামোরিনের কাছে পাঠাতে থাকে। ঠিক এই সময় কালিকটের সমস্ত হিন্দু-মুসলিম বণিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজার সঙ্গে হাত মেলালেন। নৌ-সেনাপতি কাশিম ঠিক করলেন কোচিনের কাছেই পর্তুগীজদের মুখোমুখি হতে হবে।
শুরু হয় এক ভয়াবহ লড়াই। পর্তুগীজদের কামানের বিরুদ্ধে ভারতীয় ঢাল তলোয়ার। একের পর এক ভারতীয় জাহাজ পর্তুগীজ গোলায় বিধ্বস্ত হতে থাকে। হিন্দু-মুসলিম যোদ্ধারা কিন্তু তবুও হাল ছাড়লেন না। নৌসেনাপতি কাশিমের রণচাতুর্য ছিল অসামান্য। তিনি ছোট ছোট ক্ষিপ্র গতির জাহাজগুলিকে এমনভাবে পরিচালনা করতে থাকলেন যাতে কামানের গোলা কিছুতেই লক্ষ্য ভেদ করতে না পারে। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ভাস্কো দ্য গামা হার মানেন এবং তাঁর বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যান। পর্তুগীজরা এরপর কালিকটের আশেপাশের রাজ্য কোচিন, গুজরাট, গোয়া, বোম্বাই, বিজয়নগর দখল করে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও তারা আর কালিকট দখল করতে পারেনি।
Discussion about this post