“মোদের গরব মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা”। শুধুই ভাষা নাকি, বাঙালির কাছে গোটা বাংলাই গর্বের। বাংলার রীতিনীতি সংস্কৃতি তাদের আত্মার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। আর তার সঙ্গে রয়েছে বাংলার নিজস্ব সম্পদ ভান্ডার। আর তাতেই ঘটেছে বেশ বিপত্তি। বিদেশীদের নজরে সহজেই চলে আসে সোনার ফসল ফলানো এই অঞ্চলটি। তখন অবশ্য বাংলা বলতে অবিভক্ত বাংলাই বলা ভালো।
১৪৯৮ সালে ভাস্কো-দা-গামার ভারতে আগমন। তাঁর দেখানো পথেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল স্বার্থান্বেষী বিদেশীর দল। সুলতান হোসেন শাহের সময় বাংলা উপর পর্তুগীজদের চোখ পড়ে। ১৫১৬ থেকে এরা পাকাপাকিভাবে বাংলায় আস্তানা গড়ল। কিন্তু বণিক হয়ে ঢুকে ধীরে ধীরে এরা পরিণত হয় হার্মাদ বা জলদস্যুতে। এরা নৌবিদ্যায় ছিল ভীষণ পটু। শীতের দিনে, কুয়াশা মাখা ভোরে দেখা যেত জলদস্যুদের যুদ্ধজাহাজী মাস্তুলগুলো। এক চোখে তাপ্পি, ছেঁড়া কালো পোশাক, মুখে কূট হাসি, রক্তচক্ষু চাউনি আর হাতে উদ্যত তলোয়ার। এই ছিল তাদের ভয়ঙ্কর রূপ। অন্যের বাণিজ্য জাহাজ দেখতে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত তাঁদের ওপর। চোখের নিমেষে রক্তাক্ত হত জাহাজ আর সমস্ত পণ্য হত গায়েব। চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে বহু আরবীয় জাহাজ এভাবেই লুঠ করে সমুদ্রপথে একরকম সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা। বাংলার নিরীহ গ্রামবাসীরাও তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না। এমনকি তাদের অপহরণ করে দাস হিসেবে বিক্রিও চলত।
গঙ্গার উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে তখন একরকম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জনমানবশূন্য হয় সেসব এলাকা। তবে এদের সাথে তাল মিলিয়ে আসে আরও একটি বিদেশী জাতি, আরকানের (মায়ানমার) মগরা। হিন্দু সমাজে এদের ছোঁয়াও ছিল নিষিদ্ধ। এরা মূলতঃ নারীদের শিকার করে ভোগ করত। বাংলায় পর্তুগীজ ও মগদের উস্কানি দিত আসামীরা। বাংলার খুঁটিনাটি খবর পৌঁছে দিত এদের কাছে, বদলে তাদের জীবনে রক্ষা করত দস্যুরা। বাংলার লুঠ করা সম্পদ ও বন্দীদের নিয়ে যেত নিজেদের দেশে। তারপর চলত জয়ের মোচ্ছব।
হার্মাদ ও মগরা প্রথমে যৌথ আক্রমন চালালেও, পরে সম্পর্কে আসে ছেদ। দিল্লীতে যখন আকবর শাসন চালাচ্ছেন, তখন এই জলদস্যুদের তান্ডব কিছুটা থিতিয়ে পড়ে। কিন্তু জাহাঙ্গীরের আমলে তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উপদ্রবের জেরে জাহাঙ্গীর বাংলার রাজধানী ঢাকায় সরিয়ে নিলেন। এরপর আসে সেই প্রলয়ঙ্করী অধ্যায়। দিল্লীর সিংহাসনে তখন সম্রাট শাহজাহান। তাঁর হুঙ্কারেই মুঘল ও পর্তুগীজ নামল সম্মুখ সমরে। তিনমাস ধরে চলল রক্তক্ষয়ী এক সংগ্রাম। ১৬৬৬ সালে ২৮৮ রণতরীর নৌবাহিনী নিয়ে মুঘল সেনাপতি চট্টগ্রামে অভিযান চালালেন। একের পর এক পর্তুগীজ ঘাঁটি ধ্বংস হল। হার্মাদরা এবার সরে আসে চন্দনগরে। ব্রিটিশ আমলেও কলকাতা নগরীতে হার্মাদ ও মগের আতঙ্ক চোখে পড়ত। ১৭৯০ সালে ব্রিটিশ সরকার হাওড়ার শিবপুরে গঙ্গায় বাঁধ টানেন। তাতেই মগ ও হার্মাদদের আসা যাওয়ার পথ বন্ধ হল। বাংলা চিরতরে মুক্তি পেল জলদস্যুদের হাত থেকে। ইতিহাসেও ঘটল এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি।
Discussion about this post