শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মভূমি ও লীলাক্ষেত্র নবদ্বীপ ধাম। বৈষ্ণব তীর্থভূমি হিসেবেই অতি পরিচিত নবদ্বীপ ধাম বৈষ্ণব ও শাক্ত চিন্তাধারার মিলনভূমি। শহরের বুকে ছড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন মন্দির। শহরের প্রায় মধ্যভাগে অবস্থিত এক বৃহদাকার বটগাছ। সাধারণ মনে হলেও এই বটবৃক্ষের নীচেই পূজিতা হন বহু শতাব্দী প্রাচীন নবদ্বীপের জাগ্রত পোড়া মা। বিগ্রহ বিহীন পোড়া মায়ের মন্দির প্রতিদিনই ফুল মালা দিয়ে সাজানো থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে দেবীর দর্শনে আসেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। লোক মুখে নানা রকম কাহিনী ছড়িয়ে আছে নবদ্বীপের এই ‘পোড়া-মা’কে নিয়ে।
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় সময়টা পনেরো শতাব্দী। বৃহদ্রথ নামে এক তন্ত্রসাধক ও সিদ্ধ সন্ন্যাসী বাস করতেন নবদ্বীপে। তন্ত্র সাধনাতে সিদ্ধি লাভ করতে, তিনি বনের মধ্যে দেবী কালিকাকে স্থাপন করছিলেন একটি ঘটে। সেই ঘটেই তিনি দেবীর নিত্য পুজো করতেন নিষ্ঠা ভরে। কাল চক্রে একদিন ইহলোক ত্যাগ করলেন সন্ন্যাসী বৃহদ্রথ। বৃহদ্রথের প্রয়াণের পর পূজার দ্বায়িত্ব পেলেন বাসুদেব। তিনি বন থেকে দেবীর ঘটটি এনে নবদ্বীপের কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করলেন। একটি বৃক্ষতলে ঘটটিকে পুনঃস্থাপন করে সেখানে তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করলেন এক চতুষ্পাঠী। পরবর্তী সময়ে দেবীর সেবার ব্যবস্থা করেন নদিয়ার রাজবংশ।
বাসুদেব সার্বভৌম প্রতিষ্ঠিত সেই মা-কালিকা স্বরূপিণী ঘটে নিত্যপূজা ও ভক্তসমাগম ঘটত সেই বৃক্ষতলে। হঠাৎ একদিন বাজ পড়ে সেই গাছে। প্রচন্ড অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় গাছটি। সেই থেকে দেবী হয়ে গেলেন ‘পোড়া-মা ভবানী’। এরপরে নবদ্বীপের প্রাচীন একটি বটগাছের গোড়ায় ছোট্ট একটি মন্দিরে স্থাপিত হয় সেই কালিকা-মাতা ঘট এবং চলতে থাকে আগের মতোই নিষ্ঠাভরে নিত্যপূজো। মায়ের নাম অনুসারে এই জায়গা হয়ে গেছে ‘পোড়া-মা’তলা। সেবায়েতদের থেকে জানা যায় দক্ষিণ কালিকার নিয়মনীতি ও পুজ পদ্ধতিতেই পূজিত হন দেবী পোড়া-মা ভবানী।
পোড়া-মা থানের একদিকে ‘ভবতারণ’ ও অন্যদিকে ‘ভবতারিণী’মন্দির। গর্ভমন্দিরে স্থাপিত ভবতারণ যা এক বিশাল শিবলিঙ্গ। ভবতারিণী মূর্তি নিয়ে আরো রোমাঞ্চকর লোক কাহিনী প্রচলিত। ভবতারিণী মূর্তিটি নাকি আগে গনেশ মূর্তি ছিল। একসময়ে সেই মূর্তিটি গঙ্গা বক্ষে তলিয়ে যায়। পরে শুঁড় ভাঙা অবস্থায় মূর্তিটি উদ্বার করেন রাজা গিরিশচন্দ্র। তারপর নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজের মত নিয়ে অঙ্গহীন বিগ্রহটিকে ধ্যানানুযায়ী ভবতারিণী মূর্তিতে রূপ দেন। প্রতিষ্ঠা করেন বহুখ্যাত পোড়া-মা’তলার মন্দিরে। বিশাল ফালা-ফালা চোখ ও লকলকে জিভ হলেও ভবতারিণী মা বসন পরিহিতা। তাঁর হাতে নেই খাঁড়া। মা বাবু হয়ে বসে আছেন মহাদেবের বুকের ওপর।
নবদ্বীপ বাংলার ইতিহাসে এমনই একটি উজ্জ্বল নাম যে এক সময়ে একে ‘অক্সফোর্ড অফ বেঙ্গল’ বলা হত। নবদ্বীপের মানুষের কাছে পোড়ামার মহিমা অপরিসীম। নবদ্বীপবাসী যে কোনও শুভ কাজের শুরু করেন পোড়ামা দর্শন করেই। এমনকি নবদ্বীপের অন্যতম ঐতিহ্য রাসোৎসবের নবমীর দিন সমস্ত ক্লাবের শোভাযাত্রা পোড়ামা মন্দির ঘুরে পুজো দিয়ে যায়। চৈতন্য জন্মভূমির পাশাপাশি এই নবদ্বীপ ধাম পোড়া-মা ভবানী ও মা ভবতারিনীর দর্শন ক্ষেত্র হিসেবেও প্রসিদ্ধ বঙ্গবাসীর কাছে।
Discussion about this post