“বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্যবাদকের একজন আমি। এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়”- এই কথা বলেছিলেন নজরুল। ওই একই সময়ে দাঁড়িয়ে, একই ভাষায় আর একজন কবিও বলছেন, “কোনো এক নতুন কিছুর/ আছে প্রয়োজন,/ তাই আমি আসিয়াছি– আমার মতন/ আর নাই কেউ।” এই দ্বিতীয়জন হলেন রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের পরবর্তীতে বিশ শতকের অন্যতম শক্তিশালী কবি জীবনানন্দ দাশ। আজ জীবনানন্দের ১২৫তম জন্মদিন।
জীবনানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৯ সালে। আর মজার বিষয় হল নজরুল ইসলাম জন্মেছিলেন এই বছরেই, জীবনানন্দের জন্মের ঠিক তিনমাস পরেই। কবি হিসেবে নজরুল ইসলাম জীবনানন্দের এক দশক আগেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। আর জীবনানন্দ তাঁর কবিতা জীবনের শুরুতেই প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর থেকে তিন মাসের ছোট নজরুলের কবিতা চেতনা এবং কবিতা চিন্তার দ্বারা। সেই প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ঝরা পালকে’। তবে বলা বাহুল্য, পরবর্তীতে জীবনানন্দ তাঁর কবিতার স্বতন্ত্র ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন।
সমালোচকরা নজরুল কে নিয়ে বারবার বলেছেন, যে নজরুলের কবিতায় উচ্ছ্বাস যতখানি, গভীরতা নাকি ততখানি নেই। নজরুলের সমসময়ে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বিভিন্নজনের মৃদু এবং তীব্র ব্যঙ্গের শিকার হতেও হয়েছিল। আর জীবনানন্দ নিজেও নাকি সেই তালিকা থেকে বাদ নন। নজরুলের সাহিত্য নিয়ে কথা বলে নাকি চাকরি খোয়াতে হয়েছিল স্বয়ং রুপসী বাংলার কবিকে। জীবনানন্দ তখন কাজ নিয়েছিলেন দৈনিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায়। সেখানেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমালোচনা করার কারণে তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল চাকরি।
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত নজরুল সম্পর্কে বলেছেন, “বিস্তীর্ণ জনতার মাঝেও সহজে চিহ্নিত হত সে, এত প্রচুর তার প্রাণ”। আর নজরুল নিজে বলেছেন, “আমি নৃত্যপাগল ছন্দ/ আমি আপনার তালে নেচে যাই/ আমি মুক্ত জীবনানন্দ”। আর উল্টোদিকে জীবনানন্দ হয়ে উঠলেন বাংলার নির্জনতম কবি। মৃত্যুর আগে পর্যন্তও একটি বাসস্থানের বন্দোবস্ত করার জন্য এবং চাকরির ব্যবস্থার জন্য দৌড়ে দৌড়ে ক্লান্ত ছিলেন তিনি। শেষদিনগুলি ভাঙা পাঁজর নিয়ে কাটিয়েছেন কলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে। তবু বলে উঠেছেন, “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়-/ আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/ খেলা করে।”
Discussion about this post