বিশ্ব জুড়ে সংক্রামিত করোনা ভাইরাস ঘটিত রোগকে মহামারী ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। চিন দেশ থেকে শুরু হয়েছিল এই ভয়ঙ্কর সংক্রমণ। তারপর ইতালি, স্পেন সহ ইউরোপের সারা দেশ এবং বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে সে। তবে মহামারীর এই রূপ কিন্তু নতুন নয়। এর আগেও ভয়ঙ্কর এক মহামারীর সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল গোটা পৃথিবী বাসীকে। তা হল চতুর্দশ শতাব্দীর কুখ্যাত মহামারী প্লেগ, যা ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবেই বেশি পরিচিত। এটি এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মৃত্যু-পরোয়ানা। যার কারণে মাত্র পাঁচ বছরে মারা গিয়েছিলেন পৃথিবীর প্রায় দুশো মিলিয়ন মানুষ। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ এই পাঁচ বছরের মধ্যে ইওরোপের জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল।
প্লেগের জীবাণু হল ইয়ারসেনিয়া পেসটিসের ডিএনএ। কালো ইঁদুরের মাধ্যমে এই জীবাণু বাহিত হয়ে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধত। করোনার মতই প্লেগ মহামারীর সুত্রপাত চীন থেকে। ১৩৩০ সালে মঙ্গোল জাতি চিন দখল করার পর সেদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। আর যে কোনো মহামারী ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী এই দুর্বল অর্থনীতিই। ঠিক এর পরের বছরই চীনে মহামারীর আকারে দেখা দিল প্লেগ। মোঙ্গোল নেতা জানি বেগ বেশ কয়েকবার ক্রিমিয়া রাজ্যের বন্দর কাফ্ফা শহর আক্রমণ করেছিলেন। তখন প্লেগের জীবাণু মঙ্গোল সৈন্যদের মাধ্যমে ক্রিমিয়ায় পৌঁছাল। শেষ পর্যন্ত তিনি যখন এই শহর কব্জা করার চেষ্টা করলেন, তখন অধিকাংশ সৈনিকই প্লেগে আক্রান্ত। কূটবুদ্ধি খেলে গেল জানি খান বেগের মাথায়। তিনি বিনা যুদ্ধে কাফ্ফার নাগরিকদের মেরে ফেলার ফন্দী আঁটলেন। তাঁরই বুদ্ধিতে প্লেগে মৃত সৈনিকদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হল কাফ্ফা জুড়ে। হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল রোগ। ক্রিমিয়ায় তখন জেনোয়া বণিকদের দাপট। তাঁরা সারা পৃথিবীতে ওয়াইন, জলপাই তেল, মশলা, ভুট্টা, উল ইত্যাদির ব্যবসা করতেন। প্লেগের সংক্রমণ শুরু হলে বণিকরা একে একে ক্রিমিয়া ছেড়ে পালাতে শুরু করলেন।
জেনোয়া বণিকদের জাহাজ এরপর ইতালির সিসিলি বন্দরে ঘাঁটি নিল। জাহাজের আনাচে কানাচে তখন গাদাখানেক ইঁদুর আর ইঁদুরের পিঠে এঁটুলির মত লেগে থাকা পরজীবী ফ্লীর পেটে প্লেগের জীবাণু। ব্যাস, পুরো ইটালী জুড়ে শুরু হল প্লেগ মহামারী। করোনার মতোই চিনের পর আবার সেই ইতালিতে শুরু হল সংক্রমণ। ইতালির পর এবার মহামারী এগোল উত্তর পশ্চিমে। ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড আক্রান্ত হল প্লেগে। ইওরোপ জুড়ে তখন শুধুই মৃতদেহের স্তুপ। এরপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ল জার্মানি, স্ক্যান্ডানেভিয়া, রাশিয়া সহ অন্যান্য দেশে। একমাত্র বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের বাসিন্দারা বাইরের কোনও দেশের সঙ্গে ব্যবসাতে যুক্ত ছিল না। শুধু এই দুটো দেশ তাই কিছুটা হলেও বেঁচে গিয়েছিল মহামারীর হাত থেকে।
প্রাক-অ্যান্টিবায়োটিক সময়ে করোনা ভাইরাসের মতই প্লেগের কোনো ওষুধ ছিল না। রোগ বাহিত কালো ইঁদুরগুলো মারা যাওয়ার পরই থেমেছিল এই মহামারী। আজকের মত ‘ব্ল্যাক ডেথ’এর সময়ে ফোন বা ইন্টারনেটের কোনও সুবিধাই ছিল না। ছিল না রোগ প্রতিরোধের কোনো সচেতনতাও। এখন প্রতিটি মানুষের মোবাইল ফোনের কলার টিউনে বাজছে করোনার সচেতনতার বার্তা। সংক্রমণের সন্দেহে ‘কোয়ারেন্টাইন’ বা ঘরবন্দী রাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। তাই আধুনিক কালের এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যদি একটু সচেতনতা অবলম্বন করে, তাহলে এই ভাইরাস সংক্রমণ রোখাও সম্ভব হবে।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – ডক্টর’স ডায়লগ
Discussion about this post