১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। স্বাধীনতাকামী বহু মানুষের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের একবুক গর্বের দিন। মুক্তিযুদ্ধে অন্ততঃ ৩ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে প্রাপ্ত একটি দিন। তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দৌরাত্ম্য থাকার সত্ত্বেও অজস্র মানুষ জোট বেঁধেছিলেন মুক্তির আশায়। তেমনই অসম্ভব এক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিশোরী রানী শর্মা। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সহযোগীদের সাহায্য করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন নির্ভীক এই নারী। কীভাবে? চলুন জেনে নিই।
সময়টা ছিল ডিসেম্বরের শুরু। ভারতের সোনামুড়া। শীতের সন্ধ্যা তাই চারিদিক কুয়াশার চাদরে মোড়া। সেইসময় রান্নার হাঁড়িতে ভাতের ভেতর পিস্তল ও গুলি লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাচ্ছিলেন তিনি। পথে হঠাৎ পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরে গুলি চালাতে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে যান গোমতী নদীতে। স্রোতের টানে ভেসে যান অনেকদূর। মৃত ভেবে পাকিস্তানিরাও চলে যায়। কিন্তু রাখে হরি মারে কে! মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান তাদের ক্যাম্পে এবং গুলি বের করে সুস্থ করে তোলেন তাঁকে। একচুলও টলেনি তাঁর আত্মবিশ্বাস। আজও বাম কনুইয়ের ওপর সেই ক্ষত তাঁকে মনে করিয়ে দেয় বিভীষিকাময় দিনটির কথা।
তিনি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার মধ্যম বিজয়পুরের বাসিন্দা। তাঁর স্বামী অরুণপ্রসাদ শর্মাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অস্ত্র তৈরি করা থেকে শুরু করে বিকল অস্ত্র ঠিক করতে পারতেন তাঁর স্বামী। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরও স্বামী-স্ত্রীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। এই আক্ষেপ বুকে নিয়ে বছর দশেক আগে মারা যান তাঁর স্বামী। ছেলেও এক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। মেয়ে বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানায় কাজ করে যে ৫ হাজার টাকা পান সেটুকুই সম্বল।
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল জানিয়েছেন বেশ কিছু তথ্য। ভারতীয় তালিকা, দেশের গেজেট ও লাল তালিকায় কিশোরী রানী ও তাঁর স্বামী অরুণের নাম নেই। তাই তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেওয়া যাচ্ছে না। তবে তাঁরা যদি মন্ত্রণালয় বা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কাছে গিয়ে প্রমাণ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তবে এ বিষয়ে তাঁর মেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে সারাজীবন দেশের জন্য লড়ে যাওয়া মানুষটিকে স্বীকৃতি পেতে আর কী কী শর্ত মানতে হতে পারে। তিনি মনে করেন পৃথিবীতে অনেক সত্য আছে, যেগুলোর জন্য প্রমাণ লাগে না। তার বাবা-মাও তেমনই মানুষ। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার নির্বাহী অফিসার অবশ্য মনে করেন যে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে এসে যদি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তাঁর স্বীকৃতি না পান, সেটা সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক বটে।
Discussion about this post