মানুষ ও প্রাণীর সখ্যতা ও নির্ভরশীলতা আজকের কথা নয়। প্রাণী চিকিৎসার পাশাপাশিই প্রাণী কল্যাণের কথা মাথায় রেখে রচনা করেছে আইন বিষয়ক শাস্ত্র— ‘জুরিসপ্রুডেন্স’। মানুষ ও প্রাণীর এই নিবিড় বন্ধনের বেশ কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন আবেগতাড়িত করেছে বিশ্বকে। নরওয়ের সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্যার তৃতীয় নিলস ওলাভ-এর কাহিনী তার মধ্যে অন্যতম!
ঘটনাটি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা চিড়িয়াখানার। ২০০৮ সালে নরওয়ের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে নাইটহুডে ভূষিত হন তৃতীয় নিলস ওলাভ। নাইট উপাধি পাওয়ার ফলে তাঁকে স্যার ডাকাই নিয়ম। তা এই স্যার তৃতীয় নিলস ওলাভ কিন্তু যে-সে ব্যক্তি নন, তিনি এক পেঙ্গুইন! ৬ বছর বয়সে নাইটহুড উপাধি পাওয়ার সময় সে ছিল ‘কর্নেল–ইন–চিফ’! ২ ফুট ৮ ইঞ্চির নিলস বিশ্বের সবচেয়ে খর্বাকৃতির ‘নাইট’ও বটে। তবে সে পেঙ্গুইন বলে তার সম্মাননায় কিন্তু কোনো খামতি ছিল না। যাবতীয় রাজকীয় ও সামরিক নিয়মনীতি মেনেই নিলস ওলাভকে এই সম্মাননা দেন ব্রিটিশ মেজর জেনারেল ইউয়েন লাউডেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নরওয়ের রাজা পঞ্চম হ্যারল্ড। নরওয়েজীয় গার্ডের ৩০ সদস্যের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় কাঁধে তলোয়ার ছোঁয়ানোর রেওয়াজ, কুচকাওয়াজ, সংগীত পরিবেশন, আপ্যায়ন ইত্যাদি। সাথে পেট পুরে মাছ খেয়েছিল ছোট্ট এই নাইট।
তবে তৃতীয় নিলস ওলাভ একমাত্র পেঙ্গুইন নয়, যে এই বিরল সম্মাননার অধিকারী। অ্যান্টার্কটিকার জাতীয় প্রাণীটিকে নরওয়ের সামরিক বাহিনীর সদস্য ও মাসকটের সম্মাননা দেওয়ার অভূতপূর্ব এই রীতিটি শুরু হয়েছিল সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। আসলে এই বাহিনীর তরুণ লেফটেন্যান্ট নিলস এগলিয়েন ছিলেন পেঙ্গুইনপ্রেমী। সেই আবেগ থেকেই ১৯৭২ সালে স্কটল্যান্ডের এডিনবরা চিড়িয়াখানার কিং পেঙ্গুইনদের সম্মানিত করার রেওয়াজ তিনি চালু করেন। সেই থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় নিলস-এর পর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই তৃতীয় নিলস ওলাভ পায় ‘স্যার’ উপাধি।
২০১৬ সালে তৃতীয় নিলস তার অসামান্য সেবা ও ভালো আচরণের জন্য ‘ব্রিগেডিয়ার’ হিসেবে পদোন্নতি পায়। ২০০৫ সালে এই পেঙ্গুইনের সম্মানে এডিনবরা চিড়িয়াখানায় একটি ব্রোঞ্জের তৈরি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়। আরও একটি ভাস্কর্য স্থাপিত আছে নরওয়ের অসলো শহরে। ইতিহাসের পাতায় মানুষ ও পেঙ্গুইনের বন্ধুত্বের আরও এক অভূতপূর্ব নিদর্শন রেখেছে সাউথ আমেরিকার ডিনডিম। প্রতি বছর ৮০০০ কিমি সমুদ্রপথ পেরিয়ে তার ব্রাজিলীয় মানুষ-বন্ধু জোয়াও পেরেইরা ডি’সুজার সাথে দেখা করতে আসে সে। পৃথিবীর বুকে যুগে যুগে প্রাণীদের ওপর ঘটা নৃশংস নির্যাতনের কলঙ্ক মানব জাতি মুছে ফেলতে পারবে না কখনই! কিন্তু এই পৃথিবীতেই জন্ম নেন নিলস এগলিয়েনের মত কিছু মানুষ, যাঁরা কিছুটা হলেও ভালোবাসার প্রলেপ লাগিয়ে যান সেই ক্ষতে!
Discussion about this post