আমেরিকান রেস্তোরাঁয় গান গাইছেন একদল কালো মানুষ। তাঁদের বাজনায় যেন বেজে উঠছে বহু বছরের ব্যথা। তাঁরা গাইছেন মানুষের গান। ট্রাম্পেট থেকে ছিটকে আসছে অধিকারবোধ। স্যাক্সোফোনের সুর যেন ঠাট্টা করছে মদের গ্লাসের টুংটাং কে। গানের সুরে জেগে উঠছে রাগ। সেই রাগ ফুটিয়ে তুলছে সমস্ত কালো মানুষের যন্ত্রণাকে। এই থেকেই তৈরি হচ্ছিল কালো মানুষের আন্দোলন, চিৎকার করে উঠে তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমেরিকা ফর আমেরিকানস’ নয়, ‘আমেরিকা ফর অল’। এই আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ পল রবসন। রবসনের গলায় ছিল কালো মানুষের মুক্তির কথা, উপনিবেশ উচ্ছেদের কথা, সমতা ও মানবাধিকারের কথা, সর্বোপরি মানবমুক্তির কথা। আজ তাঁর মৃত্যুদিন।
গণসঙ্গীত, শিল্পীসংগ্রামী, জনসংগ্রামের কথা উঠলেই সরাসরি মনে আসে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ভুপেন হাজারিকা, সফদর হাশমি, নাজিম হিকমত, হ্যারি বেলাফন্টের মত নামগুলি। তবে প্রায় প্রতিটি নামেরই অণুপ্রেরনা পল রবসন। তাঁর জন্ম আমেরিকার নিউজার্সিতে ১৮৯৮ সালের ৯ এপ্রিল। বাবা ছিলেন ক্রীতদাস, পরে গীর্জার পাদ্রী। স্কুলজীবনেই খেলা, অভিনয় ও গান গাওয়া শুরু করেছিলেন রবসন। আইনের ছাত্র পল পড়াশোনা করেছিলেন কলম্বিয়া ল স্কুলে। একাধারে গায়ক, নায়ক, সুঠামদেহী আ্যথলিট, ফুটবল-বাস্কেটবল-বেসবল খেলোয়াড়, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও কলম্বিয়া আইন স্কুলের কৃতি ছাত্র। পেয়েছিলেন রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভ্যালেডিক্টোরিয়ান স্টুডেন্ট’-এর সম্মান। তাঁর টুপিতে রয়েছে গ্র্যামি লাইফটাইম আ্যচিভমেন্টের পালকও।
এই বহুমুখী প্রতিভা সবচেয়ে বেশি পরিচিত হয়েছিলেন মানবদরদী গান ও রাজনৈতিক-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। কথা বলেছিলেন কয়লা শ্রমিকদের পক্ষে। অবহেলিত কালো মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। লিখতেন ভিয়েতনামের বিপ্লবী হো চি মিনের পত্রিকায়। আমেরিকার বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের আন্দোলনগুলিতে নিয়মিত সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরকার তাঁকে মেনে নেয়নি। ১৯৫০ সালে তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি নজরবন্দি থাকেন। তবুও তাঁর লড়াই থেমে থাকেনি। দীর্ঘদিনের মামলার পর ১৯৫৮ সালে পাসপোর্ট হাতে পেয়েই তিনি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়া সফরে বেরিয়ে পড়েন। গান গাইবার জন্য, রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘবদ্ধ করার জন্য।
পল রবসন ছিলেন ভুপেন হাজারিকার ভাবগুরু। রবসনের ‘ওল্ড ম্যান রিভারে’র অব্যর্থ বাংলা অনুবাদ করে তিনি আমাদের রোমাঞ্চে, বিস্ময়ে, বেদনায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। রবসনের শেষ বয়সে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘এত কিছুর কী প্রয়োজন ছিল?’, রবসন উত্তর দেন, “আমার কোনোকিছুই অপ্রয়োজনীয় ছিল না।’’ রবসন বলতেন তাঁর আন্দোলন ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। তিনি বলতেন, “Artists are the gatekeepers of truth. We are civilization’s anchor. We are the compass for humanity’s conscience.”। তাঁর আদর্শকে আজও বয়ে নিয়ে চলেছে কিছু কিছু মানুষ। তারা আজও প্রশ্ন করে উঠছে, “নৈতিকতার স্খলন দেখেও/ মানবতার পতন দেখেও/ নির্লজ্জ অলস ভাবে বইছ কেন?’’
Discussion about this post