“ওরা আমাদের গান গাইতে দেয়না, নিগ্রো ভাই আমার পল রবসন। আমরা আমাদের গান গাই, ওরা চায়না।” তুরস্কের স্বনামধন্য কবি নাজিম হিকমতের এই কবিতাটির বাংলা গণসঙ্গীত রূপটির সুরকার ও গীতিকার ছিলেন কমল সরকার। আর বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে তাঁর সংগঠন ‘মাস সিঙ্গার্স’ এই গানটি প্রথম পরিবেশন করে। কিন্তু গানটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যার নাম, সেই মানুষটির পরিচয় কী? কে এই পল রবসন?
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু বিপ্লব ও বিদ্রোহের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল গান ও কবিতা। যেমন কোনও কোনও ‘হীরক রাজা’কে থামানোর জন্য কয়েকটা ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ জাতীয় গানই যথেষ্ট ছিল। আবার শোষণ ও ত্রাসের প্রতীক রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গীত ছিল অন্যতম মাধ্যম। রবসন ছিলেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়ে চলা গণমানুষের এক শিল্পী। তাঁর কণ্ঠে ছিলো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মুক্তির কথা, উপনিবেশ উচ্ছেদের কথা, সমানাধিকারের কথা, সর্বোপরি মানব মুক্তির কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক মার্কিন মুলুকে বিপ্লবের মুখ হয়ে ওঠেন। শুধু গান ও অভিনয়ের মধ্যেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। অবহেলিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকার ও সম্মান আদায়ের জন্য তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এই কারণেই মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষের মুখে পড়তে হয় তাঁকে।
১৮৯৮ সালের ৯ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা শৈশবে একজন ক্রীতদাস ছিলেন, পরে হন গির্জার পাদ্রী। ছাত্রজীবনে পড়াশোনার সাথে সাথে একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। বহুমাত্রিক প্রতিভাময় শিল্পী হিসেবে মঞ্চনাটক ও চলচ্চিত্রে দক্ষ অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ২০টি ভাষা জানতেন। তাঁর কণ্ঠে চিনা, রুশ, ইংলিশ বা জার্মান ভাষায় গাওয়া অনেক গান রয়েছে। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ছিলেন তাঁরই ভাবশিষ্য। তাঁকে অনুসরণ করেই ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন, “বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি গঙ্গা বইছ কেন?”
বিশ্ব মহামারীর মাঝে বর্তমানে আমেরিকায় উদ্ভূত পরিস্থিতি যেন আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সভ্যতা এগিয়ে গেলেও আসলে সভ্য আমরা হতে পারিনি। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু আমাদের সভ্যতার অন্ধকার দিকটিকেই তুলে ধরে। রবসন বলেছিলেন, “Because my father was a slave, and my people died to build this country, and I am going to stay right here and have a part of it just like you.” তিনি আজ ইহ জগতে নেই ঠিকই। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। “ওদের বন্দুকই শেষ কথা নয়… সানডিয়াগোর সমস্ত খনি আর কারখানায় শ্রমিকের চেতনায় আমি আছি, আমার মৃত্যু নেই…” সত্যিই! মৃত্যুহীন আজও রবসন। তাই তো আজও জ্বলে বিদ্রোহের আগুন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজও এক হয়েছেন সকলে। মানুষের চেতনায় মিশে আছে তাঁরই বিপ্লবী চেতনা। আজও তিনি লড়ছেন গণসঙ্গীতের সুরের মধ্যে দিয়ে।
Discussion about this post