পুরুলিয়ায় পর্যটন শুনলেই হয়ত অনেকে নাক কুঁচকোবেন। ভাববেন কি আর আছে ওই রুক্ষ শুষ্ক লালমাটির দেশে। বসন্তের আগুনে পলাশ, অযোধ্যা পঞ্চকোট ঝালদার মতো সবুজ পাহাড়, আর ওই টুসু ভাদুর উৎসব। কিন্তু এসবের বাইরেও পুরুলিয়ার আনাচে কানাচে রয়েছে এমন কিছু দৃশ্যপট যা আপনাকে স্তম্ভিত করবে। তার মধ্যে একটি হল পাখি পাহাড়। পাখি পাহাড় নামটা শুনে হয়ত ভাবছেন পাখিরা বুঝি ভিড় জমায় এই পাহাড়ে তাই এমন মজার নাম। তা কিন্তু একেবারেই নয়। এর পেছনে রয়েছে বহু বছরের রক্তজল করা পরিশ্রমের আস্ত এক কাহিনী।
পাহাড় মানেই ধাপে ধাপে বনস্পতির বাস। কিন্তু এই পাহাড়টি সম্পূর্ণ আঢাকা ন্যাড়া। তাই আদিবাসীরা একে ‘মুররা বুরু’ বা ন্যাড়া পাহাড়ও বলে থাকে। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের অন্তর্গত মাঠা রেঞ্জের শ্রীরামপুর গ্রামে এর অবস্থান। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটি বিশাল পাহাড়ের গায়ে কে যেন পাখির ছবি এঁকে রেখেছে। কাছে গেলে বোঝা যায় এসব ছবি নয় পাহাড় খোদাই করা অদ্ভুত শৈল্পিকতা। আর এসবের স্রষ্টা হলেন শিল্পী চিত্ত দে। ১৯৮৪ সালে কলকাতা গর্ভমেন্ট কলেজ অফ আর্টস থেকে ডিপ্লোমা করে তাঁর শিলা খোদাইয়ের প্রতি প্রবল ইচ্ছে জন্মায়। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পীরা চার দেয়ালের মধ্যে পাথর এনে ভাস্কর্যের রূপ দান করে থাকেন। কিন্তু চিত্তবাবু আগ্রহী ছিলেন ইন-সিটু রক ক্রেভিং অর্থাৎ পাথরের কাছে গিয়ে শিল্পের সাধনায়। বহু যুগ পর এই ধরণের ভাস্কর্যের উদ্যোগ কেউ নিলেন। আর সেই উদ্দেশ্যে ১৯৯৫ সালে তিনি চলে আসেন পুরুলিয়ায় এবং আবিষ্কার করেন এই অনাবৃত পাহাড়টিকে। একজন লোক হঠাৎই জঙ্গলের মধ্যে পড়ে থাকা পাথর কুঁদে চলেছে দেখে গ্রামবাসীরা ভাবে পাগলের প্রলাপ। কিন্তু তিনি সেসবে গুরুত্ব না দিয়ে গ্রামের ৫০ জন যুবককে জড়ো করে কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। ১৯৯৯ এ প্রাথমিক আঁকার কাজ শেষ হওয়ার পর আর্থিক অনুদান নিয়ে ২০০৮ থেকেই শুরু করেন পাহাড় কেটে পাখি বানানোর কাজ।
হাতে ছেনি হাতুড়ি। শরীর ঝুলছে পাহাড়ের উঁচু থেকে টানা সেফটি রোপে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোজ ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রম করে চলেছেন চিত্তবাবু ও তাঁর সাথীরা। ১২০ ফুট থেকে ৫০ফুট দৈর্ঘ্যের ডানা মেলা ৬৫টি পাখিকে খোদাই করে ফেললেন চিরকালের জন্য ওই পাহাড়ের গায়ে। আর এই উড়ন্ত এক ঝাঁক পাখির অর্থ হল মুক্তির একরাশ আনন্দ। শুধুই গম্বুজ পাহাড় নয় আশেপাশে পড়ে থাকা পাথরেও চিত্তবাবু তাঁর হাতের ছাপ রেখে গেছেন শিল্পের মধ্য দিয়ে। লতাপাতা থেকে খরগোশ হরিণ ময়ূর হাতির মাথা সবেরই প্রতিকৃতি রয়েছে পাথরগুলোতে। এছাড়া বিলুপ্ত প্রাণী প্যাঙ্গোলিনেরও হদিশ মেলে পাথরের গায়ে। নীল সাদা হলুদ রঙের প্রলেপে সেসব খোদাই আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
চিত্তবাবু যেন ওই মৌন পাহাড়কে কথা বলতে শিখিয়েছেন। তার গা বেয়ে চলেছে কত কল্পনার বুনন। এই কৃত্রিম ভাস্কর্যে বারবার বিস্মিত হয় আগত পর্যটকরা। এ কাজ যেন ভাবনারও অতীত। সময় যত এগোবে প্রজন্ম তত এগোবে। কিন্তু হাজার গল্পকথা বলা পাখি পাহাড় পড়ে থাকবে এই যুগের পরিচয় হয়ে।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – পূরবী ভুঁইয়া
Discussion about this post