আধুনিক ক্রিসমাস গাছগুলির সূচনা জার্মানিতে রেনেসাঁসের সময় হয়েছিল। এর উৎপত্তি ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান সংস্কারক মার্টিন লুথারের সঙ্গে জড়িয়ে। কথিত আছে যে তিনি প্রথম ক্রিসমাস ট্রি’কে আলোকিত করার জন্য মোমবাতি জুড়েছিলেন। ক্রিসমাস ট্রি একটি সাজানো গাছ। সাধারণত একটি চিরসবুজ শঙ্কু আকৃতির যেমন স্প্রুস, পাইন বা ফার অথবা একই রকমের কৃত্রিম গাছ ক্রিসমাস উদযাপনের সাথে যুক্ত। এই রীতিটি মধ্যযুগীয় লিভোনিয়াতে (বর্তমান এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া) প্রচলিত হয়। আধুনিক জার্মানির প্রথম দিকে জার্মান প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানরা তাদের ঘরে এই গাছ নিয়ে আসেন।
গাছটি ঐতিহ্যগতভাবে রঙিন কাগজ, আপেল, ওয়েফার, টিনসেল, মিষ্টি মিট দিয়ে তৈরি গোলাপ দিয়ে সাজানো ছিল।মোরাভিয়ান খ্রিস্টানরা মোমবাতি দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি আলোকিত করতে শুরু করে, যা ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ মোমের আগুনে যে কোনও সময়ে অগ্নিকান্ড ঘটার সম্ভাবনা থাকতো। তবে বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর থেকে তা বৈদ্যুতিক বাল্ব দিয়ে সাজানো হয়।
১৮৮০ সালে টমাস আলফা এডিসন বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করে গোটা বিশ্বকে চমক লাগিয়ে দেন। প্রথম বৈদ্যুতিক ক্রিসমাস বাতির সাথেও মিশে আছে টমাস আলভা এডিসনের নাম। ১৮৮০ সালে বড়দিনের মরসুমে এডিসন তার মেনলো পার্ক ল্যাবরেটরির বাইরে বৈদ্যুতিক তারের মাধ্যমে অনেকগুলো বাতি ঝুলিয়েছিলেন। যদিও বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার করে বড়দিনের আলোকসজ্জা তৈরি এবং উদযাপনের প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন এডিসনের ল্যাবরেটরির একজন কর্মচারী। ১৮৮২ সালের বড়দিনে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর এডিসনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তার কোম্পানির প্রেসিডেন্ট, এডওয়ার্ড এইচ জনসন সর্বপ্রথম ক্রিসমাস ট্রির আলোকসজ্জায় বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার করেছিলেন।
জনসনের তৈরি এই বৈদ্যুতিক আলো সমৃদ্ধ ক্রিসমাস ট্রির উচ্চতা ছিল প্রায় ছয় ফুট। এতে বিভিন্ন রঙের প্রায় ১২০টি বাতি লাগান হয়েছিল। গাছের গায়ে মোট ছয় সেট বৈদ্যুতিক বাতি যুক্ত করা হয়েছিল। এদের মধ্যে এক সেট সাদা আলোর বাতি গাছটি ঘুরতে থাকলে জ্বলে উঠতো। গাছের চারদিকে ৬ সারির তামার ব্যান্ড এবং সঙ্গে একটি করে সুইচ যুক্ত করে বিভিন্ন সেটের বাতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ করা হয়। বিচ্ছিন্ন করার একটি সহজ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন তিনি। এতে নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন সেটের বাতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতো, আবার বিচ্ছিন্ন হতো। প্রথম সেট ছিল সাদা বাতির সেট। এর পরের সেট ছিল লাল আলোর। লাল আলোর বাতির সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে হলুদ বাতি জ্বলে উঠতো। এভাবে অন্যান্য রঙের বাতিগুলোও নিয়মিত বিরতিতে সাদা আলোর সাথে মিশ্রিত হয়ে জ্বলতো-নিভতো। আবার বড় ডায়নামো থেকে ছোট ডায়নামো থেকে সংযোগ বিছিন্ন করার একটি পদ্ধতিও ছিল। এতে গাছ ঘূর্ণনরত অবস্থায় না থাকলেও এর বৈদ্যুতিক বাতিগুলো ঠিকই জ্বলতো।
জনসনের তৈরি বৈদ্যুতিক ক্রিসমাস ট্রি’র খবর ম্যাগাজিন এবং পত্রিকার পাতায় আসার পর তা বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবে চারদিকে পরিচিতি পেতে থাকে। এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতির কোম্পানিও এটি জনসাধারণের জন্য তৈরি করতে শুরু করে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে লাভের মুখ দেখতে না দেখতেই ব্যবসা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণ হলো তখনও বিদ্যুৎ জনসাধারণের মাঝে সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি। বিদ্যুতের দাম, বৈদ্যুতিক বাতির দাম, ইলেকট্রিশিয়ানের সার্ভিস চার্জ – সব মিলিয়ে এই বৈদ্যুতিক ক্রিসমাস ট্রি’র ক্রয়ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই ছিল।
এডিসনের বৈদ্যুতিক বাতির আবিষ্কারের সূত্র ধরে যে বৈদ্যুতিক ক্রিসমাস ট্রি লাইটের প্রজন্ম তা কালক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। বড়দিনের উৎসব মানেই যেন বাহারি রঙের বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় সুসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রি। বর্তমানে ক্রিসমাস ট্রি’তে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন রঙের আধুনিক এলআইডি লাইট। সময়ের সাথে সাথে বৈদ্যুতিক বাতির প্রযুক্তি উন্নততর হবে। ফলে বড়দিন উৎসবের এই অপরিহার্য উপাদানটিও আরও বিকশিত হবে। তবে এই অগ্রগতির দৌড়ে টমাস আলফা এডিসনকে ঠিকই মনে রাখবে ইতিহাস।
Discussion about this post