বাঙালির ঐতিহ্য-ইতিহাসের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ হল পুজো পার্বণ থেকে যাবতীয় উৎসব। উৎসব-উপাচার ছাড়াও তার উপকরণের তালিকা বিস্তৃত। বিচিত্র ঐতিহ্য থেকে ইতিহাসের প্রধান দলিল হিসেবে ধর্মীয় স্থানের ভূমিকাও অন্যতম! ঐতিহ্যের প্রতিফলক তো বটেই কখনো কখনো সে নিজেই হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের সমার্থক। বাস্তবক্ষেত্রে অনেকাংশেই লক্ষ্য করা যায় আমরা ইতিহাস সংরক্ষণে অপারগ। কিন্তু এই কয়েকশো বছরের পুরোনো মন্দিরের দেয়াল মনে করিয়ে দেয় আমাদের ভুলে যাওয়া স্মৃতি। যেমন মালদহের রতুয়া ব্লকের গোবরজনা গ্রামের কালী পুজোর ইতিহাস।
বাঙালি মস্তিষ্কে দেবী চৌধুরানীর বাস্তব পরিচয়ের থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে তাঁর পরিচয় বেশি উজ্জ্বল। অনেকের কাছে বাংলা সাহিত্যের ‘রবিন হুড’। এই মালদহের গোবরজনা গ্রামের কালী পুজোর ইতিহাসের সঙ্গে তিনি সরাসরি যুক্ত।
গল্পটা সেই সময়ের যখন ঘন অরণ্যে মোড়ানো ছিল গোবরজনা গ্রাম। আর মালদহের কালিন্দ্রী নদীর তখন ভরা যৌবন। তাঁর স্রোতে বয়ে চলতে বড়ো বড়ো নৌকার থেকে বজরার দল। ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরানী তাঁদের যাত্রার অংশ সেবার এই কালিন্দ্রী। তাঁদের গন্তব্য বঙ্গের উত্তরে। কিন্তু তাঁদের বজরা মাঝ পথেই থেমে গেল নদীর এক বালিয়াড়িতে। দেবী চৌধুরানী স্বপ্নাদেশ পেলেন মা কালীর। তিনি সেখানে তাঁদের পুজো নিতে চান। ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরানী সেখানেই মায়ের মূর্তি তৈরি করে পুজো সম্পন্ন করলেন।
সেই থেকেই গোবরজনায় আজও সমান ভাবে হয়ে আসছে পুজো। যে পুজোয় জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ অংশগ্রহণ করে। দর্শনার্থী আসেন পাশের রাজ্য থেকেও। তবে দেবী চৌধুরানীর এই কাহিনী অনেকেই মানতে চান না। তাদের কাছে এই পুজো আরো পুরনো। এক সময় সেই এলাকায় নাকি বসবাস ছিল রাজপুতদের। তাঁরাই প্রথম এখানে শুরু করেন দেবীর আরাধনা। তবে ইতিহাস তাই হোক এই পুজোর বর্তমান এখনো রঙীন। পুজোর এখন সমস্ত দায়িত্ব সামলান সুধাংশু চৌধুরীর পরিবার। তবে এ পুজো সর্বজনীন। মহামারীর আগ পর্যন্ত পুজো উপলক্ষ্যে ছোটো খাটো মেলা বসত। লক্ষাধিক মানুষের ভিড় সামলাতে প্রয়োজন হয় পুলিশী নিরাপত্তার। সাড়ে তিনশো বছরের এই পুজোয় ইতিহাস যেন আজও কথা বলে নিজের মতো। এই পুজো তো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং মালদহ তথা বাংলার ঐতিহ্য! যেখানে ভক্তের বিশ্বাসেই আজও বেঁচে থাকে দেবী চৌধুরানী কিংবা সেই রাজপুতদের বংশ।
Discussion about this post