গত ২৬ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে রাস উৎসব। হেমন্তের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব রাস। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার উৎসব – এটি প্রতি বছর কার্তিক পূর্ণিমার তিথিতে পালন করা হয়। আর এই রাস বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন রীতি অনুযায়ী পালিত হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় রাস উপলক্ষ্যে মেলাও বসে। রাস উপলক্ষ্যে আয়োজিত একটি প্রাচীনতম মেলা হল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ময়নাগড়ের রাসমেলা।
ময়নাগড়ের রাসমেলার বয়স হল প্রায় ৪৬৩ বছর। মাকড়দহ ও কালীদহ নামে দুটি পরিখা দিয়ে ঘেরা এই ময়নাগড়। জানা গেছে, ১৫৬১ সালে ময়নাগড়ের রাজপরিবারের গোবর্ধন বাহুবলীন্দ্র কালীদহের তীরে তাদের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জিউ মন্দিরে প্রথম রাসের মেলা শুরু করেন। সেই থেকে প্রতিবছর ময়নাগড়ের রাজপরিবারের উদ্যোগেই ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭০ সাল থেকে স্থানীয় মেলা কমিটি এই মেলাটি আয়োজনের দায়িত্ব নেয়। জেলা পরিষদের উদ্যোগে ২০১২ সালে গঠিত হয় ময়না রাসমেলা কমিটি।
ময়নাগড়ের রাস উৎসবকে ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের আবেগ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। এই ময়নাগড় একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও বহন করে চলেছে। লাউসেনের ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে উল্লেখ আছে এই জায়গার। ময়নাগড়ের রাসমেলার একটি বিশেষত্ব রয়েছে যা দেখার জন্য প্রতিবছর বহু মানুষ ভিড় জমায় এই স্থানে। এই মেলার একটি বিশেষ আকর্ষণ হল, কার্তিক পূর্ণিমার দিন মাঝরাতে ময়না রাজপরিবারের কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জিউকে নিয়ে নৌকাযাত্রা। এই রাস উৎসবের পরম্পরা অনুযায়ী, কুলদেবতা শ্যামসুন্দর জিউ মূল মন্দির থেকে নৌকাবিহারে কালীদহের লাবণ্যময় জল পর পর আটদিন ধরে পরিক্রমণ করে ময়না রাস মন্দিরে প্রবেশ করেন। শেষদিন ঢাক-ঢোল, আতশবাজি, বাতাসা-লুট ও কীর্তন সহযোগে রাসমন্দির থেকে নৌকাবিহারে কুলদেবতা ফিরে যান রাজবাড়ির মূলমন্দিরে। এই নৌকাবিহার শেষ হলেও মেলা চলে আরও এক সপ্তাহ। আর এই দৃশ্য দেখার জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন এখানকার মানুষজন।
প্রায় ১৫ দিন ধরে এই মেলা চলে। ময়নাগড়ের রাসমেলায় পাওয়া যায় সেখানকার বিখ্যাত মিষ্টি। ফুটবলের মতো কদমা ও থালার মতো বড় বড় বাতাসা এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। সেইসঙ্গে এই মেলাতে বিভিন্ন লোকশিল্পী ও কুটিরশিল্পীরাও তাদের শিল্পকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। পোড়ামাটির সামগ্রী, মাটির পাত্র, কারুকার্যে ভরা মাদুর প্রভৃতি এই মেলায় দেখতে পাওয়া যায়। ময়না রাসমেলার অন্য একটি বিশেষ দিক হল এখানে মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ নেই। রাসমেলা পরিচালনার কাজে হিন্দু ও মুসলমান সব মানুষই যোগ দেন। এক কথায় একে বলা যায়, এ যেন সব ধর্মের মিলন মেলা। এই সম্প্রীতির নির্দশনই ময়নাগড়ের মেলাকে এনে দিয়েছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের স্বীকৃতি।
Discussion about this post