ব্রিটিশ আমলে কলকাতা ছিল তাদের প্রথম রাজধানী। ফলত পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে কান পাতলেই শোনা যায় কোনও না কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা। এমনই এক ইতিহাসের নৌকা বয়ে নিয়ে চলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি গ্রাম। সময় যেখানে থেমে আছে। দেওয়ালে দেওয়ালে আজও ইতিহাসের ছাপ। এখানেই এককালে গড়ে উঠেছিল বাংলার সম্ভবত প্রথম ডাকঘর, ‘কেডগিরি পোস্ট অফিস’।
খেজুরি ব্রিটিশ আমলের অত্যন্ত প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি জনপদ। ব্রিটিশ আমলের একেবারে শুরুর দিকে খেজুরি হয়ে উঠেছিল তাদের অন্যতম বন্দর। বন্দরটির এমনকি ব্রিটিশ আমলের আগেও অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। কারণ সময়ে অসময়ে ঐস্থানে ডাচ এবং পর্তুগিজ জলদস্যুরা আক্রমণ করতো বলে শোনা যায়। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা বন্দর স্থাপিত হওয়ার আগে এখানেই বড়ো জাহাজ থাকত। ফলত ব্রিটিশরা এই স্থানটিকে ধীরে ধীরে নিজেদের বসবাসের যোগ্য বানিয়ে তোলে। এমনকি রাজা রামমোহন এই খেজুরি বন্দর থেকেই তাঁর বিদেশ যাত্রা করেন প্রথম।
এতো গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হওয়ার দরুণ, এই জনপদকে ঘিরে ওঠে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস ইত্যাদি। তার মধ্যে এই ডাকঘর একটি অনেক বড়ো দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। এখান থেকে চিঠি কলকাতার চিঠি পাঠানো হত বিলেতে, বিলেতের চিঠিও খেজুরি হয়ে পাঠানো হত কলকাতায়। ১৯৫১-৫২ সালে ভারতের প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন চালু হয়েছিল কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার, সেখান থেকে কাঁকুড়হাটি এবং কাঁকুড়হাটি থেকে খেজুরি অবধি। ছোট নৌকার সাহায্যে অনেক সময় বহু জাহাজেই চিঠি পাঠানো হত। ডাকঘরের কাছেই রয়েছে ডাকবাংলো। দেওয়ালে কান পেতে চোখ বন্ধ করলেই যেন সময় থমকে দেওয়া যাবে। যেন মনে মনে শোনা যায় কোনও এক অনামী ব্রিটিশের স্বজনকে পাঠানো চিঠির ইংরেজি কথোপকথন।
ইউরোপে ব্রিটিশদের সংবাদ আদান প্রদানে একটি বড়ো ভূমিকা ছিল এই ডাকঘরের। তবে এখন এই ডাকঘরের অবস্থা পুরোটাই ভগ্নপ্রায়। তবু দাঁড়িয়ে আছে, ইতিহাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সময়ের সাথে লড়াই করে। খেজুরি বন্দরটি আঠেরো শতকেই ভয়াবহ একটি ঘূর্ণি ঝড়ে তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু শহরের বুকে সেই ব্রিটিশ আমলের ছাপ রেখে গেছে স্থানে স্থানে। এই সমস্ত ইমারত সরকারের সংরক্ষণ করে রাখাই উচিত। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ওখানের বিধায়ক সুনির্মল পাইক এটিকে সংস্কার ও সংরক্ষণের কথা উঠিয়েছিলেন। এশিয়াটিক সোসাইটি, ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে এই ডাকঘরের উল্লেখ আছে। আড়াইশো বছরের ইতিহাসকে আজও আঁকড়ে বেঁচে আছে এই ভগ্ন ডাকঘর।
Discussion about this post