গরমের ছুটি, তীব্র দাবদাহ, পাখার হাওয়া যেন গায়ে লাগে না, আর লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই! পালা করে হাতপাখার হাওয়াই সম্বল। হঠাৎ নিস্তব্ধ দুপুরের নির্জনতাকে ছাপিয়ে কানে আসে মৃদু ঘণ্টা। বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলের হৃদয় যেন নেচে ওঠে। কারণ ওই ঘণ্টাধ্বনি বয়ে আনছে শীতল আরাম। আইসক্রিম! আজকের এই বাস্কিন্স রবিন্সের যুগের ‘ক্রিমি-রিচ’ আইসস্ক্রিমের কথা হচ্ছেনা। হচ্ছে সেই নিষিদ্ধ রঙিন বরফের গোলার কথা। বাবা মায়েদের কথায় যা কিনা তৈরি হয় ড্রেনের জল থেকে কিংবা মাছ-মাংস সংরক্ষণের বরফ থেকে। কিন্তু যে প্রজন্ম নর্দমা কিংবা নোংরার গাদা থেকে হাত দিয়ে বল কুড়িয়ে অনায়াসে ক্রিকেট খেলেছে, সেই প্রজন্মকে কি এই তুচ্ছ আতঙ্ক দিয়ে থোড়াই ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে?
না, এই সমস্ত নিষেধাজ্ঞা কখনই গোলা আইসক্রিম কে কারো থেকেই দূরে রাখতে পারে নি। স্কুলের টিফিনের সময়ের হুলুস্থুলু হোক, ছুটির ঘণ্টা হোক, কিংবা বাবা-মা কে এড়িয়ে দাদু-ঠাকুমার কাছে আবদার করা হোক গরমকালের সবসময়ের সঙ্গী যেন এই গোলা আইসক্রিম। গরমের ছুটি পড়বে, স্কুলের শেষদিন। ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দুদ্দাড় দৌড়। কে কত আগে পৌঁছবে গোলাওয়ালার কাছে। আর পছন্দের রঙটি নির্বাচন করবে। কেউ বা টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে একটি গোলা হাতে নিয়ে অতি সন্তর্পণে চোখ বুজে আস্বাদ নিচ্ছে। কেউ বা ঝামেলা মারপিট জুড়ে দিয়েছে একে-ওপরের সঙ্গে। কারা আবার একটা গোলা থেকেই ভাগ করে কামড় বসাচ্ছে আর জিভ বার করে জিভের রঙ কার কত গভীর দেখে নিচ্ছে। এ তো আশি থেকে নব্বই দশকের গ্রাম, মফস্বল বা শহরতলীর অতি পরিচিত দৃশ্য।
প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে গরমের দুপুরে হঠাৎ সাইকেল ভ্যানের সামনে দড়ি দিয়ে বাঁধা চোঙা বেজে উঠত। চোঙায় বাজত বিচিত্র সমস্ত লোকগীতি। আর পিলপিল করে ছেলেরা জড়ো হত, কারণ? ভ্যানে করে এসেছে কুলফি আর গোলা আইসক্রিম। বর্তমানে যন্ত্রের যুগে, ঝাঁ-চকচকে আইসক্রিম পার্লারের যুগে বরফের গোলা আর সিরাপ মেশানো সেই বহু কাঙ্ক্ষিত আস্বাদ পাওয়া দুষ্কর। আজকাল ইন্টারনেট খুঁজলেই পাওয়া যাবে ঘরেই কীভাবে সুষ্ঠুভাবে বানানো যায় সবরকম আইসক্রিম।
সমস্তই হাতের এত কাছে, যে গরমকালের সেই গোলাওয়ালার ডাক বা ঘণ্টার অপেক্ষা আজ নস্টালজিয়ায় পরিণত হয়েছে। স্কুলের বাইরেও আজ আর গোলাওয়ালার সন্ধান পাওয়া যায়না, দুপুরের রাস্তায় কোয়ালিটি ওয়ালস- রলিক-ক্রিমবেল প্রভৃতি নামজাদা কোম্পানির রঙিন পলিথিনে মোড়া আইসস্ক্রিম আসে। আর সাইকেল ভ্যানে চেপে গ্রাম গ্রাম ঘুরে বেড়ানো সেই গোলাওয়ালা বা কুলফিওয়ালাটির খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা আজ বিরল থেকে বিরলতর।
Discussion about this post