ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম নীরা আর্য। আজাদ হিন্দ ফৌজের রানি ঝাঁসি রেজিমেন্টের সদস্যা এবং প্রথম নারী গুপ্তচর হিসেবে নীরা কেবল বাহ্যিক শক্তিতে নয়, আদর্শে, ত্যাগে এবং সাহসে নিজেকে অমর করে তুলেছিলেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ওপর প্রাণঘাতী হামলার সময় নিজের স্বামী শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসকে (যিনি ছিলেন ব্রিটিশ সিআইডির গুপ্তচর) বেয়নেট দিয়ে হত্যা করেন নীরা, নেতাজিকে বাঁচাতে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি বেছে নিয়েছিলেন দেশপ্রেমের কঠিনতম পথ। এই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য নেতাজি তাঁকে ডাকতেন ‘নাগিনী’ নামে।

নীরার জীবনীতে উঠে আসে অগণিত দুঃসাহসিক অভিযান। সরস্বতী রাজামণির সঙ্গে পুরুষদের পোশাকে ব্রিটিশ সেনাঘাঁটিতে গুপ্তচরবৃত্তি, বন্দি সহযোদ্ধাকে উদ্ধারের জন্য নপুংসক নর্তকীর ছদ্মবেশে অভিযান, তিনদিন গাছে লুকিয়ে থাকার মতো কাহিনিগুলি যেন সিনেমার চিত্রনাট্যকেও হার মানায়। এ জন্য তাঁকে INA-র অধিনায়কের পদে উন্নীত করা হয়। তবে এই বীরত্বের দাম তাঁকে দিতে হয়েছিল নির্মম অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। স্বামী হত্যার অভিযোগে তাঁকে পাঠানো হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে, যেখানে তাঁকে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তাঁর বুকের উপর নেতাজির প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ শুনে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁর স্তন ছিঁড়ে নেওয়ার মতো নৃশংস চেষ্টা করে, শুধু তথ্য জানার জন্য।

স্বাধীনতার পরে একটিও সরকারি সাহায্য না নিয়ে, হায়দ্রাবাদের ফালকনুমার এক কুঁড়ে ঘরে ফুল বিক্রি করে দিন কাটাতেন নীরা। শেষ জীবনে নিঃস্ব ও অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৮ সালের ২৬ জুলাই তিনি ওসমানিয়া হাসপাতালে মারা যান। সরকারি জমিতে থাকার কারণে মৃত্যুর আগেই তাঁর আশ্রয়টুকু কেড়ে নেওয়া হয়। কোনও রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই স্থানীয় মানুষেরাই শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন।

এ এক নির্মম বাস্তব, যাঁর শরীর দিয়ে রক্ত ঝরেছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, সেই নারীকেই আমরা ভুলে গেছি। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসে নীরা আর্য এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, যাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ আমাদের মাথা নত করতে বাধ্য করে। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি, কারণ বীরাঙ্গনা মাত্রেই কেবল অস্ত্রধারিণী নন, তাঁরা ইতিহাসের হৃদয় জোড়া হাহাকারও।
Discussion about this post