প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের কাছে যে শিল্পী মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠেন তাঁর শিল্পের জন্য, তেমন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম নাম হল নাজিম হিকমত। কবি নাজিম হিকমত। যাঁর উপর করা হয়েছে অত্যাচার। যাঁকে মেরে ফেলতে চাওয়া হয়েছে। জন্ম ভূমির নাগরিকত্ব যাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যাঁর অধিকাংশ কবিতাই লেখা হয়েছে জেলখানায় বসে। জেলখানার জুলুম যাঁকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। আর মানুষকে যিনি ভেবে গেছেন পাখির মত সরল। সম্প্রতি পেরিয়ে গেল সেই কবির জন্মদিন।
“ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চায়/ বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে/ আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়/ ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে”- এই লেখা বিংশ শতাব্দীর কবি নাজিম হিকমতের। তাঁর জন্ম ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি তুরস্কের সালোনিকায়, যা বর্তমানে অবস্থান করছে গ্রিসে। নাজিম হিকমতের বাবা ছিলেন তুর্কি এবং মা জার্মান। মা ছিলেন শিল্পী। অটোমান সাম্রাজ্যের বিখ্যাত যোদ্ধা নাজিম পাশা ছিলেন তাঁর দাদা। তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে পড়াশোনার শেষে নৌবাহিনীতে যোগদান, শারীরিক অসুস্থতার জন্য নৌবাহিনী ত্যাগ করে রাজনীতিতে ঢোকেন তিনি। উনিশ বছর বয়সে নাজিম তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন।
নাজিম হিকমত কলম ধরেছিলেন শ্রেণি বিভক্ত সমাজের বিরুদ্ধে। তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার পর, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছায় তিনি জর্জিয়া যান। সেখান থেকে যান মস্কো। মস্কোর ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সময় তিনি পরিচিত হন মার্ক্স ও লেনিনের মতবাদের সঙ্গে। তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন রুশ কবি মায়াকোভস্কির। তুরস্ক স্বাধীন হবার তিনি দেশে ফেরেন স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন। ১৯২৪ সালে ২২ বছর বয়সে বন্দি হয়েছিলেন প্রথমবার। তাঁর মুক্তির জন্য বিবৃতি দিয়েছিলেন, মিছিল করেছিলেন পাবলো নেরুদা, জ্যঁ পল সার্ত্র ও আরও অনেকে। পরবর্তীতে ইস্তাম্বুলের জেলেও তিনি বন্দি ছিলেন আট বছর। প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাঁর ‘জেলখানার চিঠি’ কাব্যগ্রন্থ।
জ্যঁ পল সার্ত্র লিখেছিলেন, ‘নাজিম হিকমত এমনই একজন কবি, যার কাব্য আর জীবনের মাঝে কোনো ভেদরেখা টানা যায় না!’ সত্যিই নাজিম হিকমতের কবিতা এবং জীবনের সংজ্ঞা যেন সমান হয়ে উঠেছে। তিনি যেন সারাজীবন ধরে কবিতা দিয়ে জীবন আর জীবন দিয়েই কবিতা লিখেছেন। হয়ে উঠেছেন বিপ্লবের কবি, প্রতিবাদের কবি, মানুষের কবি। নাজিম হিকমতকে নিয়ে পাবলো নেরুদা লিখেছিলেন, “সদ্য মুক্তি পাওয়া/ বন্দীদের একজন নাজিম হিকমত/ তার কবিতার মতো/ লাল রং সোনার সুতায়/ বোনা জামা উপহার দিয়েছে আমায়।” নাজিম হিকমত তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিপ্লবের সেই লাল রঙের স্বপ্ন।
চিত্রঋণঃ আজাদ খান ভাসানি (ফেসবুক মারফৎ)
Discussion about this post