ছাতা, রেইনকোট নয়, একটা সময় বাংলার গ্রামে বর্ষাকালের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছিল তালপাতার টোকা বা “পেখে” বা “পেখা”। বাংলাদেশের নোয়াখালীতে এটি পরিচিত জোংরা নামে। চাষিরা ধানক্ষেতে কাজের সময় মাথায় পেখে দিয়ে বৃষ্টি আটকাতেন; গরমে হাতপাখা যেমন অপরিহার্য ছিল, তেমনি বর্ষায় পেখে। এখন কী এই পেখে? এটি মূলত তৈরি হত তালপাতা ও বাকলের দড়ি দিয়ে। আঞ্চলিক ভাষায় অনেকে একে “পাখিয়া” নামে চিনতেন। গ্রামীণ মেলাগুলি ছিল পেখে বিক্রির প্রধান কেন্দ্র। আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায়, ছাতা ও রেনকোটের সহজলভ্যতায় এবং পলিথিন-ত্রিপলের সস্তা বিকল্প পাওয়ায় পেখে প্রায় বিলুপ্তির পথে।
সময় অনেক বদলে গেছে। এখন ছাতা, রেনকোট ও প্লাস্টিক শিটের সহজলভ্যতার কারণে পেখের কদর অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়াও আছে তালগাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, কুসংস্কারের কারণে নতুন তালগাছ না লাগানো এবং চাহিদার পতনে অনেক কারিগর এই পেশা ছেড়ে অন্য জীবিকার পথে চলে গেছেন। আগে যেখানে একটি বাজারে বর্ষার মৌসুমে শতাধিক পেখে বিক্রি হতো, এখন সিকিভাগও বিক্রি হয় না। তবুও কিছু গ্রামে এখনও কয়েকটি পরিবার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য আঁকড়ে পেখে তৈরি চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মতে, ঝোড়ো হাওয়া ও ভারী বৃষ্টিতে পলিথিন বা ত্রিপলের চেয়ে তালপাতার পেখে অনেক বেশি কার্যকর।
পেখে তৈরি কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ নয়। প্রথমে তালগাছ থেকে বড় বড় পাতা কেটে এনে পুকুরে পচিয়ে নরম করা হত। তারপর সেই পাতা থেকে সরু সরু ফিতে বানানো। সেই ফিতে দিয়ে হাতে বোনা হত পেখে। পেখে দেখতে প্রায় অর্ধেক নৌকার মতো। পেখে বা পেখা নামটির উৎপত্তি “পাখা” বা “পাখনা” থেকে, কারণ এর তলার অংশ দেখতে অনেকটা ডানার মতো। একসময় পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি প্রভৃতি জেলার বাজার, হাট, গ্রামীণ উৎসবেও প্রচুর পেখে বিক্রি হতো। নতুন পেখে কিনে আনার পর পরিবারের প্রবীণা সদস্যরা তাতে আলতা বা রঙ দিয়ে নাম বা সংকেত লিখে রাখতেন, যাতে অদলবদল না হয়।
আজ তালপাতার টোকা প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক গ্রামীণ শিল্প। মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি ও আশপাশের কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও অল্প কিছু কারিগর ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন, তবে তাঁদের সংখ্যা দ্রুত কমছে। অনেক লোকশিল্পী ইতিমধ্যেই মারা গেছেন, আর নতুন প্রজন্ম আগ্রহ হারাচ্ছে। ফলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, শিগগিরই পেখে হয়তো কেবল সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত থাকবে, বাংলার লোকশিল্পের এক অবলুপ্ত অধ্যায় হয়ে। এক সময়ের গ্রামীণ জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ, পেখে আজ স্মৃতি, nostalgia আর হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের প্রতীক।
Discussion about this post