কলকাতার নারকেলডাঙা অঞ্চলে ১৯২৫ সালে পত্তন হয় বোসপাড়ার। পশুপতি বসু, চারুচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রনাথ বসু এবং আশুতোষ মিত্র নামের এই চার ব্যক্তি প্রথম থাকতে আসেন এখানে। জয় নারায়ণ তর্ক পঞ্চানন লেনের সতেরো নং বাড়িটি ছিল শ্রী বিনীত কুমার ভট্টাচার্য্যের। এনার আদি বাড়িতে অন্নপূর্ণা পূজো চলে আসছে বহু বছর আগে থেকেই। এছাড়াও স্যার গুরুদাস ব্যানার্জীর বাড়িতে হত জগদ্ধাত্রী পূজো, যা এখনও হয়। ষষ্ঠীতলা মন্দিরে হত দূর্গা পুজো। ওই চারজন ব্যক্তি এই পাড়ায় কালিপূজো করার কথা ভাবেন। যদিও যে কোনও নতুন পূজো গুরুদাস বাবুর অনুমতি ছাড়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে তাঁর জেষ্ঠ্যপুত্র উপেন্দ্রনাথের অনুমতিতে কালী পুজো শুরু হয়। যদিও তিনি শর্ত রাখেন পূজোয় পশুবলি দেওয়া যাবে না, ফলবলি দেওয়া যেতে পারে। প্রতিমার বর্ণ হতে হবে নবদূর্বাদল ঘনশ্যাম। অর্থাৎ কচি সবুজ ঘাসের বর্ণের সাথে ঘনশ্যাম বর্ণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দেবীর গায়ের রঙ নির্ধারিত হল। প্রতিমা বানানোর বায়না দেওয়া হল কমল পালকে।
পুজো শুরু হল ১৯২৬ সালে। সেই সময় মন্ডপ বানাতেন পাড়ার লোকেরাই এবং মন্ডপসজ্জা হত নতুন শাড়ি দিয়ে। পুজোর দিন সকালবেলা মুটের মাথায় করে আসত প্রতিমা। বিকেলবেলায় হত কালী কীর্তন যা শুরু করেছিলেন স্বয়ং যতীন্দ্রনাথ বসু। তিনি ছিলেন ‘নারকেলডাঙা কালী কীর্তন সমিতি’র অন্যতম সদস্য। পুজোর পুরোহিত ছিলেন বিনীত কুমার ভট্টাচার্য্য। পুজো শেষ হলে হত যাত্রাপালা, যেখানে অভিনয় করতেন ছবি বিশ্বাসের মতো নামজাদা শিল্পীরা। সারারাত ধরেই চলত যাত্রাপালা। পরবর্তীকালে পর্দা টাঙিয়ে প্রোজেক্টরের মাধ্যমে পরিবেশিত হত বায়োস্কোপ।
বর্তমানে যাত্রাপালা ও বায়োস্কোপ বন্ধ হয়ে গেলেও রয়ে গিয়েছে রাত জাগার রীতি। পুজো পরের দিনই হত বিসর্জন। বেশ কিছু বছর পরে অবশ্য শুরু হয় আরেক নতুন রীতি। বিসর্জন দিয়ে ফেরার পর সম্মিলিতভাবে খিচুড়ি খাওয়ানোর চল রয়েছে এখনও। ধীরে ধীরে এই পূজো বোসপাড়ার মানুষদের কাছে হয়ে উঠল বাৎসরিক উৎসব। এমনই উন্মাদনা সৃষ্টি হয় এই পুজোকে ঘিরে, যে নতুন ক্যালেন্ডার পাওয়ার পর দূর্গা পুজোর পরিবর্তে কালী পুজোর তিথি ও ক্ষণ গুনতে শুরু করে দেন এলাকাবাসী।
লক্ষ্মী পুজোর দিনই শুরু হত ঘর বাঁধার কাজ। তখন থেকেই উঠত সাজো সাজো রব। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে ফিরত মেয়েরা। দিন গোনার সাথে সাথে শুরু হয়ে যেত প্যান্ডেল সাজানোর কাজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া। পুজো দিন হাজির হলেই ১২ নং থেকে ২২নং বাড়ি একটি পরিবারে পরিণত হয়। বর্তমানে এই পাড়ার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ প্রসূন কুমার বসু জানান, তাঁদের বাবা-জ্যাঠাদের থেকে নাতি-নাতনিদের দেখছেন তিনি। কিন্তু পুজোর উন্মাদনা বিন্দুমাত্র কমেনি। তিনি আরও বলেন, “ছোটবেলায় বাবা-জ্যাঠাদের দেখতাম মন্ডপ সজ্জা করতে। যদিও তখন আমাদের একটাই কাজ ছিল। প্রতিমা রাখার বেদি মাটি দিয়ে তৈরি করা। আমাদের পুজোতে পাড়ার বাইরে থেকে কোনোরকম চাঁদা নেওয়া হয় না। এমনকি পাড়ার লোকেদের জন্যেও কোনো নির্ধারিত চাঁদা নেই। তবে মোটামুটি প্রত্যেকেই নিজ দায়িত্বে কিছু না কিছু ব্যয়ভার বহন করে।”
নারকেলডাঙা বোসপাড়ার এই পুজোর বিশেষত্ব হলো বেশ কিছু পুরনো রীতি ও ঐতিহ্য বহন করে চলা। যার মধ্যে অন্যতম হল লক্ষ্মী পুজোর দিন থেকেই পাড়ার মানুষের মিলিত প্রচেষ্টায় ঘর বাঁধার কাজ শুরু করা, বিসর্জনের পর খাওয়া-দাওয়া। এছাড়াও রয়েছে ন’পোয়া মাপের বাংলা কালী যার সাজ এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি মাটির তৈরী এবং প্রতিমার নবদূর্বাদল ঘনশ্যাম বর্ণ এই পুজোর অভিনবত্ব হিসেবে ধরা হয়। পুজোর কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম প্রবীরবাবু আমাদের বলেন, “এ বছর মহামারীর কারণে পুজোর আয়োজনে কিছু ঘাটতি হচ্ছে। বিসর্জনের পরের খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে। যদিও সামাজিক দূরত্ববিধি মেনেই হবে পুজোর অঞ্জলী ও যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠান।”
তথ্য ঋণ – তীর্থ নারায়ণ ভট্টাচার্য্য
Discussion about this post