বাঙালি মেয়েরা বরাবর শাড়ি পরতে ভালোবাসে। পার্বন দিন হোক বা বিয়েবাড়ি! মেয়েরা এখনও খুঁজে পেতে বেছে নেয় মায়ের আলমারির কাপড়। সে আলমারির অন্যতম সদস্য তাঁতের কাপড়। মায়ের আটপৌরে আঁচলের যা কিছু ওম! সব লেগে থাকে তাঁতের সুতোয়। আভিজাত্যের সুর বয়ে চলে এই শাড়ি। এই আভিজাত্যের ছোঁয়া আর আঁচলের আদর যাঁরা বোনেন! আমরা রাখিনি তাদের হারিয়ে যাওয়ার খবর। রামজীবনপুরের প্রসিদ্ধ তাঁত শিল্প তাই অবলুপ্তির পথে।
আনুমানিক পাঁচশো বছর ধরে ভারতে প্রসিদ্ধি পেয়েছে তাঁতশিল্প। তৎকালে দু’রকম তাঁত শাড়ির প্রচলন ছিল। এক ধনীগৃহের মসলিন। অন্যটি সাধারণের সুতির শাড়ি। তাঁত মূলতঃ একধরনের যন্ত্র। তুলোজাত সুতো থেকে কাপড় বানানো যায় তা দিয়ে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের বসাক সম্প্রদায় আদি তাঁতি। বাংলা ভাগের পর তাঁরা পশ্চিম ও পূর্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যান। তখন তাঁতের পসার ছিল ভালো। অনেকেই কাজ শিখে জীবন চালাতো। তেমনই প্রসিদ্ধ তাঁতশিল্প ছিল রামজীবনপুরে। পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা এক নম্বর ব্লকের রামজীবনপুর। এর তিন নম্বর ওয়ার্ড ছিল তৎকালীন তাঁতের পীঠস্থান। এখন গণেশজননী পল্লীর ওই বাসিন্দারা খুব সহজেই আপন করেছে অভাব। উদয়াস্ত তাঁতকল চালনা আর মহাজনদের কাছে লোকসানে তাঁতের শাড়ি বিক্রি করাই তাদের এখনকার যাপনচিত্র।
গ্রাম্য তাঁতি ভাইদের সাথে কাজ করেন বাড়ির মেয়ে বউরাও। চরকায় পাড়ের কাজ করেন মেয়েরা। ছেলেরা সারাদিন চালান তাঁত কল। সকলেই বংশপরম্পরায় এই পেশায় যুক্ত। কল চালাতে ব্যস্ত এক তাঁতশিল্পীর কথায়, “এই কাজে লাভ নেই। সবটাই লোকসান। সারাদিন কল চালিয়ে মজুরি পাই দেড়শো। তাতে কি আর সংসার চলে!” অন্য আরেকজন বললেন,”আগে সুতোর কাজ করতাম। পয়সা তেমন পেতাম না। এখন তাই রেশমের কাপড় বুনছি। এতে মজুরি বেশি। দৈনিক তিনশো টাকা।” এই পেশায় কেউ থাকতে চান না আর। সকলেই জমিতে ঠিকা কাজ করতে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ দুঃখের সাথে বললেন,”বাপ ঠাকুরদার আমলের পেশা! তাও উঠে যাচ্ছে!”
বারো হাতি শাড়িতে পাড়ের নকশার বুনোট এখানকার শিল্পের মূল বিশেষত্ব। ছ’হাতি ধুতিও মেলে এখানে। তাঁত তৈরি হয় সুতো দিয়ে। সুতোকে রাসায়নিকে ধুয়ে শুকিয়ে মাড় দিয়ে প্রক্রিয়াকরণ করতে হয়। সেসব করে কারখানার লোক। রামজীবনপুরের শিল্পীরা মহাজনদের থেকে কিনে নেন সুতো। তারপর তাঁত বোনা যন্ত্রে খট্ খট্ খটাখট্। শাড়ি বোনা হয় এহেন শব্দ তুলে। একটা শাড়ি বুনতে একদিন লাগে। নকশায় জটিলতা থাকলে লাগে তিন-চার দিন। এইসব শাড়ি আবার তাঁরা মহাজনদের কাছেই বেচে দেন। লাভ বলতে শুধুই মজুরি। চাহিদা কম হলে দুবেলা খাবার জোটাতেও হিমশিম খান এঁরা। বিকল্প অর্থসংস্থান নেই যে! যে পেশায় হাতেখড়ি হয় পুর্বপুরুষের হাতে। সেই পেশা কেউ আর শেখাচ্ছে না পরবর্তী প্রজন্মকে। নকশাপেড়ে তাঁত শাড়ির ঐতিহ্য তাই অস্ত যেতে বসেছে।
Discussion about this post