বঙ্গদেশ একসময় ছিল তন্ত্রসাধনার পীঠস্থান। নবদ্বীপে বহু পূর্বে শুধুই শক্তির পূজা চলত। আর তা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরে শুরু হয়। নবদ্বীপে শুধু বৈষ্ণব বা তন্ত্রসাধনার ও পীঠস্থান ছিল না; প্রাচীন বাংলার অক্সফোর্ড তথা বাংলার সংস্কৃতির পীঠস্থান হিসাবে সুপরিচিত ছিল। সেই সময় শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটল নবদ্বীপে। কৃষ্ণভক্তিতে ছেয়ে গেল নবদ্বীপ। রাস পূর্ণিমার রাতে রাস উৎসবের আয়োজন শুরু হল। বৈষ্ণবদের কাছে ‘রাস’ হল ভক্ত ও ভগবানের মিলন উৎসব। শরৎকালের শারদোৎসবের পরই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। কিন্তু এখানের রাসযাত্রায় কেন শাক্ত দেবদেবীর পুজো হয়? ‘শাক্তরাস’ই বা কেন বলা হয় নবদ্বীপের এই উৎসবকে? এর পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক এক ব্যাখ্যা।
সপ্তদশ শতক। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মুক্তি পেলেন নবাবের কারাগার থেকে। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োগ করেলেন ঈশ্বর চিন্তায়, ধর্মে। কিন্তু তিনি মনে প্রাণে ছিলেন শাক্ত। মহাপ্রভুর আগমনের পর, নবদ্বীপে শক্তির পূজা একরকম বন্ধই হয়ে পড়ে। শাক্তরা তাই হাজির হলেন রাজ-দরবারে। তখন রাজা রাস পূর্ণিমাতেই শক্তির দেবদেবীরও পুজোর অনুমতি দেন। তাই একে ‘রাসকালী’ ও বলা হয়। পুজোর আগে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বারোয়ারি পুজোগুলোকে ১ টাকা করে দান করতেন। আবার পুজোর পরদিন সমস্ত প্রতিমার শ্রেষ্ঠকে পুরস্কৃতও করতেন। এখানের রাসের বিশেষত্ব হল মূর্তির বিশালতা। এছাড়া ঐদিন হিন্দুশাস্ত্রের ভিন্ন দেবদেবীর পুজোও হয়ে থাকে। মূর্তিগুলোর বিশালতা থাকলেও, সুষম সুগঠিত ও লাবণ্যময়।
নবদ্বীপের মৃত্শিল্পীদের সম্পর্কে ড. সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন,’অতিবড় মূর্তির অবয়ব গঠনে মৃত্শিল্পীর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ভারসাম্য ও বিন্যাস একেবারে নিখুঁত জ্যামিতিক। কৃষ্ণনগরের মৃত্শিল্পীরা ছোটো পুতুলে দক্ষ কিন্তু এতবড় মূর্তি গড়তে পারবে না। চন্দননগরের মৃত্শিল্পীরা বিশাল জগদ্ধাত্রী গড়তে পারেন। কিন্তু তার সুষমা কম। সবটাই ঢেকে যায় শোলার সাজের আড়ম্বরে। নবদ্বীপের সবকটি মৃত্মুর্তি সুষম, সুগঠিত ও লাবণ্যময়। এ গঠনে ধরা আছে বহুদিনের রক্তগত জাতিবিদ্যার অহংকার।’
নবদ্বীপের পট পুজো খুবই জনপ্রিয়। দশভূজা, বিন্ধ্যবাসিনী, কালী, অন্নপূর্ণা, জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তৈরি হয়। বহু দূরদুরান্ত থেকে লোক এসে যোগ দেন। পুজোর পরের দিন সকালে শোভাযাত্রা বের হয় যার পোশাকি নাম আড়ং। সকালটা যেমন শুরু হয় ১০৮ জন বেয়ারার কাঁধে গৌরাঙ্গিনী মাতার শোভাযাত্রা দিয়ে। দুপরে শোভাযাত্রা হয় দুই ভদ্রাকালীর, যেমন বিরাট মূর্তি (উচ্চতায় প্রায় ২০ হাত) তেমন সুবিশাল শোভাযাত্রা। এরপর সন্ধ্যায় আনুমানিক ৫০০ প্রতিমার শোভাযাত্রা বের হয়।প্রতিমাগুলির উচ্চতা খুব বেশি হওয়ায় নিজস্ব এক ধরনের বিশেষ লোহার গাড়ি থাকে প্রতিটি বারোয়ারির কাছেই। সব শেষে আসে নিরঞ্জন এর পালা। প্রতিমাগুলি সারারাত সারিবদ্ধভাবে শোভাযাত্রার পর পরের দিন সকালে নিরঞ্জন দেয়া হয়। পুজো শেষে ফের একবছর অপেক্ষায় থাকে নবদ্বীপের মানুষ।
তথ্য ঋণ – সপ্তক দাস, নবদ্বীপ রয়েল সোসাইটি, সোধগঙ্গা, নবদ্বীপের ইতিবৃত্ত, শান্তিরঞ্জন দেব
Discussion about this post