শরৎ মানেই বাঙালির মন থেকে প্রাণ সবটা জুড়েই দুর্গা পুজো। দুই বাংলার প্রতিটি কোণার সব শ্রেণীর মানুষ মেতে ওঠেন মাতৃ আরাধনায়। দূর্গা পুজোকে কেন্দ্র করেই রাজবেশে সেজে ওঠে মহানগরী কলকাতা। তবে জানেন কি! ‘মা দুর্গাকে’ ঘিরে পুরনো কলকাতার বুকে প্রবাদ আছে! যা আজও চিরন্তন। আজও মানা হয়, স্বর্গ থেকে ধরাধামে এসে মা দুর্গা গয়না পরেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ বাড়িতে। ১৮৪ বছর কেটে গেলেও দুর্গা পুজোতে আজও সমান উদ্যমে সেজে ওঠে কলকাতার দাঁ বাড়ি। কলকাতা জোড়াসাঁকোর দাঁ পরিবারের আদি কর্তা ছিলেন গোকুলচন্দ্র দাঁ। গোকুলচন্দ্র দাঁ’র প্রাচীন নিবাস বর্ধমান জেলার মেমারী সন্নিহিত সাতগাছিয়া অঞ্চলে। তার পুত্র শিবকৃষ্ণ দাঁ পারিবারিক সূত্রে পাওয়া হার্ডওয়ারের ব্যবসায় বহু অর্থ লাভ করেন। তখন শিবকৃষ্ণ লাভের টাকার একটা বড় অংশ দুর্গা পুজোয় ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তার হাত ধরেই ১৮৩৯ সালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দুর্গাপূজার সূচনা হয়।
দাঁ বাড়িতে রথযাত্রার দিন কাঠামো পুজো করা হয়। আগে শাল কাঠ দিয়ে দেবীর কাঠামো তৈরি হলেও এখন গরান কাঠ দিয়ে তা বানানো হয়। মহালয়ার পরের দিন প্রতিপদ থেকে এই বাড়ির পুজো আরম্ভ হয়, ওইদিন হয় দেবীর বোধন। প্রাচীন সময় থেকেই দাঁ বাড়ির প্রতিমার সুখ্যাতি ছিল অলঙ্কারের জন্যে। শিবকৃষ্ণ দাঁ সোনার গয়না দিয়ে সাজতে বড় ভালবাসতেন। একদিন তিনি ভাবলেন দেবী দুর্গাকেও মনের মতো করে একইভাবেই অলঙ্কারে সাজাবেন। জানা যায়, সেই সময় দূর্গা প্রতিমাকে সাজানোর জন্য প্যারিস আর জার্মানি থেকে হিরে আর চুনী বসানো গয়না ও শাড়ি আমদানি করেন শিবকৃষ্ণ।
১৫০ বছরেরও বেশী সময় ধরে প্রতিবার পুজোর সময় এই একই ভেলভেটের শাড়ী ও গয়নায় সেজে ওঠেন দাঁ বাড়ির ‘কন্যা’ দুর্গা। পোশাক এবং দেবীর অলঙ্কার এতটাই সুন্দর আর মনোমুগ্ধকর ছিল যে তখন মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে পড়ে যে, দেবী মর্ত্যে এসে প্রথম দাঁ বাড়িতেই পোশাক এবং অলঙ্কার পরে সাজেন। তারপর অন্য জায়গায় যান। জোড়াসাঁকোর দাঁ বাড়ির দুর্গোৎসবের কথা যুগ যুগ ধরেই নানা পুস্তক, পত্রপত্রিকায় আলোচিত হয়ে আসছে। জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর দাঁ পরিবারের দুর্গাপূজার আড়ম্বরের সঙ্গে পাল্লা দিত এই পুজো।
প্রাচীন বৈষ্ণব পদ্ধতির এই পারিবারিক দুর্গোৎসব পুরাতন বাংলার এক সজীব স্মৃতি। সন্ধি পুজোয় এক বিশেষ রীতি রয়েছে দাঁ বাড়িতে। সন্ধি পুজোর সমস্ত কাজ পরিচালনা করেন বাড়ির পুরুষেরা, বাড়ির ছেলেরা, জামাইয়েররা সকলে মিলে। অষ্টমীর দিন কুমারী পুজো হয়। এছাড়াও ধুনো পোড়ানো এই বাড়ির একটি অন্যতম রীতি। দাঁ বাড়িতে অন্নভোগের চল নেই। শুকনো চালের নৈবেদ্য ও লুচি, খাজা নানারকম মিষ্টি বাড়িতে প্রস্তুত করেই সেই খাবার নিবেদন করা হয় মা দুর্গাকে। সময়ের সাথে প্রাচীন সময়ের জৌলুস আজ কমে এলেও, ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে আজও কলকাতার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দাঁ বাড়ি।
Discussion about this post