আজকের মায়ানমার, যাকে আমরা আগে ব্রহ্মদেশ বলে জানতাম, তার সাথে আমাদের বাংলার সম্পর্ক অনেক পুরনো। ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলায়, চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বাঙালিদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বার্মিজরাও আসতেন এদেশে। দুই দেশের এই সম্পর্কের থেকেও প্রাচীন হলো ব্রহ্মদেশে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। তাই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছিল কলকাতার একমাত্র বার্মিজ বুদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরটার কথাই আজ বলবো। সেন্ট্রাল মেট্রোর যে এক্সিটের মুখটা টেরিটি বাজারের দিকে, তার সামনেই আছে একটা বড় মহারানা প্রতাপের ঘোড়ায় চড়া মূর্তি। এই মূর্তির ওপাশেই রয়েছে একটা পুরনো তেতলা বাড়ি। যার শুধু একটা সাইনবোর্ড প্রমাণ দেয় যে, এই বাড়িতেই আছে সেই মন্দির। বার্মিজ বুদ্ধমন্দিরের বাড়িসাইনবোর্ডে ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় লেখা আছে…
MYANMAR BUDDHIST TEMPLE
10A, EDEN HOSPITAL ROAD
KOLKATA – 700 073
প্রথমে কিন্তু মন্দির হিসেবে তৈরি হয়নি এই বাড়ি। ব্রহ্মদেশ থেকে আসা ইউ সান মিন (U San Min) নামের এক ভদ্রলোক ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে এই বাড়িটি কিনে নেন ৪৭০০০ টাকায়। ওখানে তিনি স্থাপন করেন একটি ধর্মশালা, যার নাম ছিল ‘Burma Buddhist Dharmashala, Calcutta’। আজও এই বাড়ির ইলেকট্রিক বিল ওনার নামেই আসে। এরপর বার্মা থেকে এসে নিয়োজিত হন এখানের প্রথম বৌদ্ধ পুরোহিত ইউ নন্দাউন্দা (U. NANDAWUNTHA)। ১৯৩২ সালে ইউ সান মিন এই বাড়ি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্যে দান করেন। বাড়িটির একতলাতে সবই দোকান, শুধু সিঁড়িটুকুর জায়গা খোলা রয়েছে ওপরে ওঠার জন্য। তবে ওপরে যাওয়া কিন্তু সহজ নয়। সিঁড়ির গেট সবসময় বন্ধ থাকে, ঘন্টি বাজালে লোক নেমে আসে। তাও ওপরে যাবার অনুমতি পাওয়া যায়না বললেই হয়। তবে আমি ভাগ্যবান ছিলাম, তাই এখন পর্যন্ত দু’বার ওখানে যেতে পেরেছি।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই মনে হয়, এই ঘিঞ্জি এলাকার মধ্যে আপনি একটা অন্য জগতে চলে এসেছেন। দেওয়ালে দেখা যায় বিভিন্ন লেখা, যা সবই বার্মিজ ভাষায়। দোতালাটা এখনো ব্যবহার হয় বার্মিজ ধর্মশালা হিসেবে। তিনতলায় ওঠার আগে শুধু দেখলাম ইংরেজিতে লেখা আছে, “Please remove your shoes”। তিনতলার কার্পেট-ঢাকা হলঘরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়বে বাঁ দিকে প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো এক নতুন ধরণের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধমূর্তি। এর গড়ন ও সাজসজ্জা স্বতন্ত্র। বুদ্ধের মুখের গড়ন আলাদা, আর কানদুটো অস্বাভাবিক রকমের বড়। মার্বেল পাথরের মূর্তির সারা শরীর সোনার পাতে কারুকার্যখচিত। অন্যান্য বুদ্ধ মন্দিরের মতই সামনে একটি ছোট টেবিলে কিছু নৈবিদ্য ও পুজো সামগ্রী সাজানো। নতুন একটা জিনিস দেখলাম, সেটা হলো কাঠের জপমালা ও রূপোর নিবেদন পাত্র।
দেওয়ালে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরে নিয়োজিত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের ছবি। তিনতলার ঝুলবারান্দাতে আরেকটা জিনিস চোখে পড়ল। সেটা হলো একটা ছোট আকারের ঢালাই লোহার কালো রঙের কাঁসর। খাবার সময় হলে, সেটা বাজিয়ে ডাক দেওয়া হয়। মন্দিরের সন্ন্যাসীরা ভাষাগত কারণ এবং অচেনা লোক হবার দরুণ, নতুন লোকেদের সাথে দেখা করতে আগ্রহী নন একেবারেই। তবে কেয়ারটেকার দাদা বাঙালি, নাম অনন্তদা। ছোটখাটো হাসিমুখের ভদ্রলোক যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখালেন। সাথে এটাও জানতে পারলাম, প্রতিবেশীদের থেকে এরা খুবই অত্যাচারিত হন। আরো জানলাম, আগে ব্রহ্মদেশের ছাত্ররা কলকাতায় পড়তে আসতো। বার্মিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেই সময়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আসতেন বার্মিজ ব্যবসায়ী ও তীর্থযাত্রীরা। এখন ছাত্ররাও নেই, ব্যবসায়ীরাও নেই। মাঝে মাঝে আসেন শুধু কিছু বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীরা। যদিও আজকে এই মন্দিরের গুরুত্ব অনেক কমে এসেছে। তাও আজকের মায়ানমারের সাথে বাংলা ও বাঙালির যে অক্ষয় বন্ধন রয়েছে, সেই নিদর্শন হিসেবে এই মন্দির এক উজ্জ্বল প্রতীক।
তথ্য ঋণ – কলকাতার উপাসনালয় : পীযূষকান্তি রায় এবং The Glass Palace : Amitav Ghosh
চিত্র ঋণ – The Concrete Paparazzi
Discussion about this post