নারী ও পুরুষ উভয়েরই বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতীক হল তাদের কেশবিন্যাস। আর যদি ওঠে দেব-দেবীদের চুলের প্রশ্ন, তাহলে তো কথাই নেই। বাংলায় তো বটেই, সারা পৃথিবীর সমস্ত সংস্কৃতিতেই দেব-দেবীদের মাথার চুলের প্রতি আলাদাভাবে যত্নবান হয়ে থাকেন শিল্পী। বাংলায় এখন পুজোর মরশুম, দুর্গা পুজো, লক্ষ্মী পুজো, কালী পুজো। তথাকথিত হিন্দুদের উৎসব। পুজো করেন হিন্দু পুরোহিত, ভোগ রান্না করেন হিন্দু ঠাকুর, পুজোর অঞ্জলীও দেন হিন্দুরাই। কিন্তু, বাংলার এই গ্রামের যে অধিকাংশ পরিবার দেবী প্রতিমার কেশদাম তৈরি করেন, তাঁরা প্রায় সকলেই মুসলমান ধর্মের মানুষ!
গ্রামের নাম পার্বতীপুর। হাওড়ার জগতবল্লভপুরের এই গ্রামে বিগত কয়েক দশক ধরেই দেব-দেবীর মাথার কৃত্রিম চুল তৈরি করে চলেছেন প্রায় দুশোটি পরিবার। মুসলমান ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মের মানুষও এই কাজে যুক্ত রয়েছেন, তবে মুসলমান ধর্মের মানুষের পরিমাণই বেশি। তাঁদের তৈরি চুল কলকাতার কুমোরটুলি ও বড়বাজারসহ, রাঁচি, পটনা ও অন্যান্য রাজ্যেও পৌঁছে যায়। এমনকি জানা গেছে বিদেশেও রপ্তানি হয় এই গ্রামের মানুষের তৈরি কৃত্রিম চুল। পুজোর এই মরশুমে তাই শ্বাস নেওয়ার সময়ও নেই জগতবল্লভপুরের কেশসজ্জার শিল্পীদের।
এই চুল তৈরির জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে সাদা পাট। হুগলির মশাট, শিয়াখালা প্রভৃতি এলাকা থেকে আনা হয় এই পাট। এই পাটকে মিহি করে, কালো, সাদা, বাদামী, সোনালী প্রভৃতি রং করার জন্য গরম করা হয় আলাদা আলাদা কড়াইতে। তারপর শুকনো করে, লোহার চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানো হয়। নির্দিষ্ট মাপে কেটে তারপর তাকে প্যাকেটজাত করা হয়। জানা গেছে, পুজোর মরশুমে জগতবল্লভপুর গ্রাম থেকে প্রতিদিনই প্রায় লড়ি বোঝাই করে চুলের প্যাকেট যায় কলকাতা সহ অন্যান্য রাজ্যে।
শুধু হাওড়া নয়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মীরপুর গ্রামেও কয়েকশ মুসলমান পরিবার পাটের চুল তৈরি করে। যা মূলত তৈরি হয় দেব-দেবীরের মাথা ঢাকার জন্যেই। এই সমস্ত শিল্পী আসলে সম্প্রীতির মত ভারী শব্দকে পাত্তাও দেন না, দেওয়ার সময় ওঁদের নেই। ওঁরা শুধু বোঝেন, পেটের টান। এই উৎসবের দিনগুলিই যেন মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেয়, যে ধর্মের ভেদাভেদ আসলে মিথ্যে। উৎসব আক্ষরিক অর্থেই সবার। “একই বৃন্তে দুটি কুসুম” যেন সত্যি হয় বারবার।
Discussion about this post