ছোটবেলা থেকেই আমার নেশা হল ঘুরে বেড়ানো। কাছে হোক বা দূরে, এদিক ঘুরতে যাওয়া আমার ভালবাসায় এক জায়গা। অবশ্যই তার জন্য বাড়ির লোকজনও অনেকাংশেই দায়ী। তবে বড় হবার সঙ্গে এই নেশাটাই যে আমার পেশা হয়ে যাবে তা আর কেই বা জানত! এই নেশা ও পেশার কারণে বহু জায়গাতেই ঘুরেছি। ভারত ও কিছু ক্ষেত্রে ভারতের বাইরেও। তবে এর মধ্যেই কিছু জায়গা এমনও রয়েছে, যেখানে একবার গেলে আর ফিরে আসতে ইচ্ছা করে না। তার মধ্যে একটি জায়গা মুন্দিরা মিউজিক্যাল ক্যাম্প। আমার আর একটা সখ হল বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়া। অনেক দিন ধরেই মুন্দিরার কথা শুনছিলাম তাই ঠিক করি বাইকেই সেখানে যাব। তাই সেই মত একদিন সকালে বেরিয়েও পড়লাম।
সেদিন সকাল ৮.৩০টায় বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। যেহেতু রাস্তা আমার চেনা তাই বেশিক্ষণ সময় লাগল না শক্তিগড় আসতে। ৯.৩০টার মধ্যেই চলে এলাম শক্তিগড়। আর সেখান থেকে ৩ ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম মুন্দিরা। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এখানে আসার দুটি রাস্তা রয়েছে। একটি সোজা দুর্গাপুর রোড ধরে বর্ধমান হয়ে পানাগড়-মালঞ্চদিহি-মুন্দিরা (তবে এই পথে জয়দেব কেন্দুলি সেতুটি ভাঙ্গা তাই গ্রামের মানুষেরা একটি বাঁশের ব্রিজ করেছেন। সেটি পেরোতে আপনাকে ১৫ টাকা করে দিতে হবে)। আর একটি বর্ধমান হয়ে গুসকরা-ইলামবাজার হয়ে মুন্দিরা। তবে দ্বিতীয় পথে গাড়ির ভিড়টা একটু বেশিই। যাওয়ার আগেই আমার এক পরিচিত বিজয়দা কে বলা ছিল। পৌঁছনো মাত্রই দাদা সোজা নিয়ে চলে গেলেন অজয় নদের ধারে। এখানে এক আখরা তৈরি করা হয়েছে যেখানে বাউলেরা সাধনা করেন।
দুপুরের খাবার খেয়ে আমি যখন আখরাতে গেলাম ততক্ষণে বাউলারা মেতে উঠেছিলেন নিজের ছন্দে। এঁরা এক গান দুই বার করেন না। এঁদের সঙ্গে কথা না বললে এও বুঝবেন না যে সঙ্গীত সাধনার জন্য এই মানুষগুলোর প্রায়ই বিদেশ থেকে ডাক পড়ে। যাই হোক, বিকেলের সূর্য নামতে নামতেই কাঙাল ক্ষ্যাপা, সাধু দাস, সনাতন বাবা, বাপি বাবা এবং আরও কিছু মানুষ এসে বোল ধরলেন। তারপর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কখন যে রাত ১০ টা বেজে গেছিল আমরা তা খেয়ালই করিনি। যেন মনে হচ্ছিল আমার জীবনের সেরা সন্ধ্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কেটেছে সেদিন। রাতে খাওয়ার পর পুরো জায়গাটা শান্ত হয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পের চারিদিকে মশালের মতো আলো আর নদের হাওয়াতে কিভাবে যে ঘুম এসে গেল জানি না। সেই ঘুম একবারে ভাঙল ভোরে। দোতরার টুং-টুং আওয়াজে।
আমরা যারা গীতগোবিন্দ অল্প হলেও জানি, তারা জানবেন যে কবি জয়দেব প্রেমের কবি ছিলেন। আমার মনে হয় সেই প্রেম তিনি এখনকার মানুষ, প্রকৃতি প্রায় সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দিয়েছেন। আপনারাও যদি সেই প্রেম বুঝতে চান তাহলে চলে আসুন মুন্দিরাতে। মন থেকে বলছি, বাঁচার কিছু না কিছু রসদ নিয়েই আপনি ফিরতে পারবেন। যা হয়তো অক্সিজেন হিসেবে কাজে লাগবে আপনার পরিচিত শহুরে সেই ব্যস্তময় জগতে।
(অভিজ্ঞতা লেখকের ব্যক্তিগত)
তথ্য ঋণ ও ছবি – অয়ন
কলমে দেব
Discussion about this post