বাঙালি মানেই খাদ্যরসিক। তেল মশলায় পরিপূর্ণ রকমারি স্বাদের খাবার ছাড়া বাঙালির ঠিক তৃপ্তি আসে না। শুধু বাংলা নয় ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে এমন সুস্বাদু বহু খাবারের রেসিপি। তবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে সুদূর আমেরিকাতে বাঙালি তথা ভারতীয় খাবারের জয়জয়কার, ভাবা যায়! এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন উত্তর কলকাতার মুক্তি ব্যানার্জি। বর্তমানে তিনি থাকেন নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে। বিদেশের মাটিতে তার হাত ধরেই ভারতীয় সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে।
বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান মুক্তি ব্যানার্জী। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি ও বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে এমএসসি ও পিএইচডি শেষ করে তিনি ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ কলেজে লেকচারার পদে যোগ দেন। এরপর তাঁর বিয়ে হয়ে যায় গোসাবা নিবাসী পার্থ ব্যানার্জীর সাথে। জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে তিনি গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড পরীক্ষা এবং বিদেশী ভাষা হিসাবে ইংরেজির পরীক্ষায় বসেন। পরীক্ষাগুলিতে তার দুর্দান্ত সাফল্যের জন্য আই এস ইউ তাকে স্কলারশিপের প্রস্তাব দেয়। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে পাড়ি দেন। ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মুক্তি নিউইয়র্ক স্টেট ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড রিসার্চে কাজ করেন। সেখানেই তিনি প্রথমে শুরু করেন অভিনব রান্নার ব্লগ। পরবর্তীতে ২০১০ সালে তার হাত ধরেই আমেরিকার মাটিতে পথ চলা শুরু করে ‘মুক্তির কিচেন’। সেখানে মুক্তিদেবী তাঁর ক্লাসে হাতে-কলমে সুস্বাদু ভারতীয় রেসিপি শেখান।
পেশায় তিনি একজন সমাজকর্মী, শিক্ষক এবং একজন আণবিক জেনেটিস্ট হলেও নেশায় তিনি একজন দক্ষ রাঁধুনি। করোনাকালীন সময়ে, অফলাইন ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলেও থেমে থাকেনি মুক্তির রান্নাঘর। এই সময় তিনি ‘জুম’ অ্যাপের মাধ্যমে রান্নার ক্লাসের মাধ্যমে রান্নার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপ সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। সময়ের সাথে আমেরিকাতে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভারতীয় এই রান্নাঘর। তাঁর রান্নার ক্লাসে ভারতীয় রান্না শিখতে নিয়মিত ভিড় জমান আমেরিকান ছাত্রছাত্রীরা। ছোট ব্যাচে ডেমো ক্লাসের মাধ্যমে তাদের শেখানো হয় ভারতীয় রান্নার পদ্ধতি। রান্না শেখানোর পাশাপাশি মুক্তিদেবী আড্ডার ছলে তাদের সামনে তুলে ধরেন ভারতের নানা সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের গল্পও।
দক্ষতা এবং তার বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের জন্য সকলের কাছে প্রশংসিত মুক্তিদেবী। উপচে পড়া শুভেচ্ছা বার্তায় ভরপুর তার অনলাইন পেজটি। মুক্তি ব্যানার্জীর কথায়, “ছোট বেলা থেকেই আমি আমার মা, ঠাকুমা সহ বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের কাছ থেকে রান্না শিখেছি। আমি আদপে একজন ভোজনরসিক এবং আমার কাকিমা বা মা বিশেষ কিছু রান্না করলেই, রান্নাঘরে ডাক পড়তো আমার। আমার কাজ ছিল চেখে দেখে খাবারের স্বাদ নিয়ে ‘বিশেষজ্ঞ’দের মতো রায় দেওয়া। এভাবেই আমি প্রতিটি মশলার নিজস্ব স্বাদ ও ব্যাবহার চিনতে শিখেছি।” কেউ ভারতে ফেরার প্রশ্ন করলে, মুক্তি হেসে বলেন, “ভারত, বিশেষ করে কলকাতা আমার হৃদয়ে আছে। ওখানেই আমার শিকড়। আমি অবশ্যই বারবার ফিরে যেতে চাই নিজের দেশে। কিন্তু এখন আমার মেয়ে বিবাহিত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে। কোনো এক অদৃশ্য পিছুটান বারবার এদেশে আটকে রাখতে চায় আমায়। আমার নাতি আমার রান্না খেতে খুব পছন্দ করে। আমার রান্না চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা আমার নাতিই।”
Discussion about this post