বরানগর হল এক বিশেষ ঐতিহ্যমন্ডিত জায়গা। এখানে পর্তুগীজরা প্রথম তাদের বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করেছিলেন, যা ১৮৬২ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। শোনা যায় পর্তুগীজদের পরে এখানে ডাচরাও তাদের ব্যবসার জন্য অফিস স্থাপন করেছিলেন, যেটি ডাচ কুঠি নামে পরিচিত ছিল। তবে আজ আর সেই ডাচ কুঠি নেই। তার জায়গায় গড়ে উঠেছে এক দৈত্যের আকারের আবাসন। এরপর বাংলায় ব্রিটিশ শক্তির উত্থানের সাথে সাথে ডাচদের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন ভুলুন্ডিত হয়ে যায়। এই অঞ্চল তাই কুঠিঘাট নামে পরিচিত আজও লোকমুখে। আর ঠিক তার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে গঙ্গা, যা কুঠিঘাট এলাকার সৌন্দর্য অসামান্য করে তুলেছে। কতশত সম্পর্ক ভাঙা গড়ার সাক্ষী এই গঙ্গার ধার। বহু স্বনামধন্য সাহিত্যিক যেমন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো মানুষের নাম এই এলাকার সাথে জড়িয়ে। এসবের সঙ্গেই বাঙালির আড্ডার রসদ তেলেভাজা থাকবে না তা কি হতে পারে?
এই বরানগরেই অবস্থিত বহু পুরনো দোকানের মধ্যে অন্যতম তেলেভাজার দোকান হল ‘মুখোরুচি’ যা আজও বরানগরবাসীর বিকেলের প্রিয় তেলেভাজার দোকান। শুধু বিকেলেই নয় সকাল থেকেই এই দোকানের দিকে তাকালে চোখে পড়ে অনেক মানুষের ভিড়। আর এই বিখ্যাত দোকান থেকেই তেলেভাজা কিনে খেতে ভালোবাসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেব। তবে পূর্বে এই দোকানটির নাম ছিল ফাগুর দোকান। মালিকের নাম ছিল ফাগুলাল শা, আর সেই থেকেই এর নামকরণ। শোনা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ দেব নিয়মিত কচুরি খেতেন এই দোকান থেকে। গিরিশ ঘোষও শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের সাথে দেখা করার পথে এই দোকানে একসাথে বসে তেলেভাজা উপভোগ করতেন। আজও বরানগরের বুকে এই ‘মুখোরুচি’ দোকানটি রমরমিয়ে চলছে।
শুরু হয় সকালে গরম গরম কচুরি আর তরকারি সহযোগে আর শেষ হয় বিকেলের কাশ্মীরি আলুর চপ, ডালের বড়া, ঢাকাই পরোটা ও আরও নিত্যনতুন মুখরোচক খাবার দিয়ে। বেশ নাম করা দোকান হলেও এই আগুনে বাজারেও দাম কিন্তু সাধ্যের মধ্যেই। মাত্র ৫ টাকা থেকে শুরু। আজকের দিনে দাড়িয়ে বহু নামী দামী মোগলাই, বিলিতি রেস্তোরাঁ বরানগরের বুকে গজিয়ে উঠেছে। তবে আজও এই ‘মুখোরুচি’র স্বাদ বাঙালি মনকে এক অদ্ভুত রকমের তৃপ্তি দেয়। বিকেলে গঙ্গার ধারে প্রিয় বন্ধুর সাথে বসে একটা মুখোরুচি’র তেলেভাজা কিনে খেতেই পারে স্বাস্থ্য সচেতন বাঙালি! আরও অনেক ঘুরে দেখার মতো জায়গার তালিকাও রয়েছে হাতের মুঠোয়। যেমন কাঁচের মন্দির, বামনদাস কালীবাড়ি, উদ্যান বাটি রয়েছে এই জনপদে। তাহলে একটা দিন “ঘ্রাণেনং অর্ধ ভোজনং” থেকে নিজেকে দূরে রেখে বরানগর ঘুরতে ঘুরতে উপভোগ করতেই পারেন ‘মুখোরুচির’ তেলেভাজা। দোসর থাকুক গঙ্গার ধারের মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি।
Discussion about this post