বাংলা সাহিত্যে স্ল্যাং বা গালাগালির উৎপত্তি ও ব্যবহার সম্পর্কে বহু বই রয়েছে এবং বাংলা ভাষা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের বিভাষা নিভাষা পড়তে হয় তাঁদের একাডেমিক জীবনে। যদিও সব কিছুর পর এ কথা সত্যি যে প্রত্যেক গালাগালির উৎপত্তি প্রধানতই কোন বিশেষ সম্প্রদায়, লিঙ্গ, পেশা, জাত, ধর্ম, বর্ণ, মানব দেহের অঙ্গ ইত্যাদিকে হীন করে দেখার স্বার্থে। এর থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় সমাজের মধ্যের অসম বিভাজনই আদতে গালাগালির উৎপত্তির একমাত্র কারণ। সাহিত্যে গালাগালির ব্যবহারের ফলে সাহিত্য অপবিত্র হয়, এই দোষারোপ আজ নতুন নয়। ৬০-৭০ এর দশকে বাংলা হাংরি আন্দোলনের সময়ের মলয় রায়চৌধুরী বা দেবী দাশগুপ্তদের লেখা সাহিত্যের বিষয়বস্তুর জন্য যত না সমালোচিত হয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি সমালোচিত হয়েছে কবিতায় স্ল্যাং ব্যবহারের জন্য। এবার তাহলে প্রশ্ন ওঠে অশ্লীল কি? মোটা দাগে উত্তর খুঁজলে পাই যাহা শ্লীল নয় তাহাই অশ্লীল। কিন্তু এর সাথে সাথেই অন্য একটি প্রশ্ন মাথা ফুঁড়ে উঠে আসে কোনটা শ্লীল সাহিত্য ও কোনটা অশ্লীল সাহিত্য এটা বিশ্লেষণ করার মাপকাঠি কে কবে কীভাবে ঠিক করলো? প্রথমের প্রশ্নের থেকেও দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
“গাঁড় মারি তোর মোটর গাড়ির
গাঁড় মারি তোর শপিং মলের
বুঝবি যখন আসবে তেড়ে
নেংটো মজুর সাবান কলের”
হাংরি আন্দোলনের কথা আগে উল্লেখ করেছি, এই সময়ের একটি কবিতা যা বাইশে শ্রাবণ মুক্তি পাওয়ার অফ প্রচারে আসেনি বেশি তাঁর কিছু পংক্তি বিশ্লেষণের স্বার্থে বিচার করছি।
“ছেলেটা খুব ভুল করেছে/ শক্ত পাথর ভেঙে,
মানুষ বড় সস্তা/ কেটে ছড়িয়ে দিলেই পারতো”
অথচ এই কবিতাটি নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়নি কারণ এই সম্পূর্ণ কবিতায় অশ্লীলতা নেই। কিন্তু একজন সমাজ সচেতন পাঠকের কাছে এই কবিতা একটি অশ্লীল সমাজের কথা বলেছে শুধু তাই না বরং একটি নগ্ন সমাজের কথা তুলে ধরেছে। আলোচনা করতে গেলে হাংরি আন্দোলনের অনেক কবিতার প্রসঙ্গই তোলা যায় কিন্তু সেই উদাহরণগুলিকে বিস্তারিত না করে একটু অন্য লেখক বা কবির লেখার কথা বলা যাক। আমাদের ছোটবেলা যে লেখক ও লেখিকার লেখা ছাড়া কল্পনা করা যায়না তাঁদের মধ্যে অন্যতম দু’জন সুকুমার রায় ও লীলা মজুমদার। সুকুমার রায়ের কালজয়ী কবিতা ‘একুশে আইন’ চিরকালই প্রত্যেক শাসক শ্রেণীর কাছে চূড়ান্ত অশ্লীল কবিতা কারণ এটি শাসকের ইচ্ছা ও অপশাসনকে ব্যঙ্গ করে। শুধু তাই নয় ‘কাকাবাবু’র প্রিয় কবিতার চার লাইন যদি আমরা আবার মনে করি,
"শুনেছ কি বলে গেল
সতীনাথ বন্দ্যো
আকাশের গায়ে নাকি
টক টক গন্ধ,
টক টক থাকে নাকো
হলে পড়ে বৃষ্টি,
তখন দেখেছি চেটে
একেবারে মিষ্টি।"
প্রথমবার পড়লে এটি একটি আদ্যন্ত নিষ্পাপ মজার কবিতা। কিন্তু কবিতার অর্থ হিসেবে যদি ধরে নিই এই বৈষম্য মূলক দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজ পচে গিয়ে টক হয়ে গিয়েছে এবং গ্রীষ্মের পর এক পশলা বৃষ্টি যেমন সবাইকে শান্তি দেয় ঠিক তেমনই সমাজের পরিবর্তন হবে। তাহলে যে ব্যক্তি এই সমাজের পক্ষে অর্থাৎ সোজা ভাষায় বর্তমান ব্যবস্থার পক্ষে তাঁর কাছে এই কবিতা চূড়ান্ত অশ্লীল, কারণ এই কবিতা এই সমাজের গুণগান করে না।অন্যদিকে যদি লীলা মজুমদারের শিশু সাহিত্যকে লক্ষ্য করি তাহলে তিনি শিশু সাহিত্যের লঘুত্বকে নষ্ট করেছেন। যে শিশু সাহিত্য এতদিন মজার বিষয় বস্তু ছিল তার সংজ্ঞার বাইরে তিনি চলে গিয়েছেন। যেমন ভুনিয়ার ফিক করে হেসে বলে সে আদিবাসী হয়েও তার বন্ধুদের বাড়িতে অপবিত্র হবে জেনেও খেতে আসে কারণ তার ক্ষিদে পায়। এবার যে ব্যক্তি হিন্দুত্ববাদের পক্ষে, যিনি মনে করেন আদিবাসীরা মানুষ তাদের কাছে এই গল্প চূড়ান্ত অশ্লীল। কারণ হিন্দু ধর্মের অপমান হচ্ছে শুধু ক্ষিদের জন্যে, ধর্মের অপমান করার কোন যৌক্তিকতাই নেই। তাই লীলা মজুমদার অশ্লীল, অপসংস্কৃতির ধারক। যদিও সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার অন্যদের তুলনায় নিতান্তই নিষ্পাপ সাহিত্যিক।
আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি রামমন্দির নিয়ে রাজনীতি হয় এবং কোন একদিন নাকি রাম মন্দির হবে। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলায় রাম বোতল থেকে একলাফে দেবতা হয়েছেন। ফলে নবনীতা দেবসেন যিনি রামকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন তার লেখায় তিনি অশ্লীলতার সীমা পেরিয়ে গিয়েছেন। কারণ তিনি ধর্ম বিশ্বাসের প্রচলিত ধারণাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে তিনিও বাদ যাবেন। বাংলা সাহিত্যে স্ল্যাংয়ের ব্যবহার হবেনা ভেবে অনেক সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পড়া বাঙালি হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু আবার এলেন নবারুণ ভট্টাচার্য। নাহ, তাকে না যায় গেলা, না যায় ফেলা। “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়” কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতা নেই, কিন্তু তাঁর কবিতা স্টানসিল দিয়ে বিদ্রোহ লেখার ডাক দেয়, তাই ভুলে যাও ফ্যাতারু কি বলতে চেয়েছিল, ভোগী লেখার কারণ কী? শুধু আলোচনা হবে তার লেখায় কোথায় কোথায় খিস্তি আছে। যদিও অভদ্র লোকটি মারা যাওয়ার পর তাঁর ওপর থেকে রাগ পড়েছে অনেকের।
শুধু সাহিত্যে কেন শিল্পের ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ প্রযোজ্য। সুবর্ণরেখা সিনেমার শেষে যখন বিজন ভট্টাচার্য দুই বাংলাকে এক করে ফেলার স্বপ্ন দেখছে, সেই সিনেমা স্বঘোষিত দেশপ্রেমীদের কাছে অশ্লীলতার পরাকাষ্ঠা। আবার মৃণাল সেনের সিনেমা ‘আকালের সন্ধানে’ দেখে কংগ্রেস সমর্থকরা বলতে পারতেন এই সিনেমা অশ্লীল কারণ কংগ্রেসের অপমান করতে কাল্পনিক গ্রামের ছবি দেখিয়েছেন। ঠিক যেভাবে আজকে দাঁড়িয়ে কবিতা গুচ্ছ ‘A country without a post office’ অশ্লীল।
আজ না হয় একজন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অশ্লীল প্যারোডি হয়েছে। ক’দিন আগে রাজনেতারা বাঙালি মনীষীদের অপমান করেননি? যদি খ্যাতির মাপকাঠি নোবেল হয় তাহলে অমর্ত্য সেনকে দেশদ্রোহী, অশিক্ষিত বলায় আপনার রক্ত কেন গরম হয়নি? কেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরোধিতা করায় তাকে কুৎসিত আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কারণ তাঁদের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করলে সন্ধ্যা বেলার অনুষ্ঠানে গান গেয়ে পড়শীর বাহবা পাওয়া যায়না। আমার ছেলে ভালো কবিতা বলে বা গান করে বলে রাতে ইসবগুলের মত একঢোক গর্ব খাওয়া গেলা যায় না।
আসলে বাঙালির বিখ্যাত হওয়ার তিনটি উপায়।
১. জীবিত – অর্থাৎ তাঁর জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলো।
২. বিবাহিত – কতগুলো বিয়ে, কার কার সাথে সম্পর্ক ছিল তা নিয়ে কুৎসা করো.
৩. মৃত – মরে গিয়েছে। তার মানে কি ভালো লোক ছিল।
আসলে এই মাপা সংস্কৃতির জন্মবৃত্তান্ত কী? কেনই বা অচলায়তন ভাঙতে চাওয়া রবীন্দ্রনাথ “ঠাকুর” হয়ে গেলেন? এর সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে গেলে মাথায় রাখতে হবে আজ যাকে নিয়ে লাফালাফি হচ্ছে ২০১২ অবধি সেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বভারতীর পেটেন্ট। বিশ্বভারতী থেকে ISO ছাপ মারা গীতবিতান বাদে বাকি সব জাল, ভুয়ো। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় পাট করা ধুতি কিংবা শাড়ি পরে হারমোনিয়াম নিয়ে গান করা আর টেক্সট বইয়ের কবিতা জোর করে গিলে নম্বর আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। যে রবীন্দ্রনাথ নিজের মেয়ে মারা যাওয়ার দিন রাতে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে নিজের মতামত রাখতে মিটিংয়ে গিয়েছেন। মূর্তি পুজো নয় মানুষের মধ্যে ভগবানকে খুঁজতে শিখিয়েছেন। আসলে পেটেন্ট প্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে না রাখলে ইনস্টিটিউশনগুলো খেতে পাবেনা। বইতে পড়তে ভালো লাগলেও গাছের নিচে খোলা হাওয়ায় সবার মধ্যে দিয়ে সংস্কৃতি চর্চা বাস্তবে হয়না।
শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আমাদের পড়তে দেওয়া হয়নি কারণ তা রাম লক্ষণের শৌর্যের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে বিভীষণের পক্ষে কথা বলে। আপনি মাধ্যমিকে কোটেশন বাদে সুকান্তর যন্ত্রন কে বুঝতে দেননি যার থেকে তিনি পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির মত দেখেছেন। আর যে ছাত্র-ছাত্রী কবিতা গল্প পড়তে চাইতো তাঁদের মেপে দিয়েছেন সে কী কী পড়বে? আর এই অচলায়তনকে ভেঙে ফেলতেই বিকৃত রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ হয়ে উঠছে আজকের জেনারেশনের। না রোদ্দুর রায়ের প্যারোডি কোন উচ্চ মানের সাহিত্য নয়। কিন্তু আজকের জেনারেশনের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের বাইরে গিয়ে প্যারোডি কানা মামা হয়ে ওঠার পেছনে স্কেলে মাপা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দায়ী নয়তো? সেটাও একবার ভেবে দেখুন।
Discussion about this post